জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী জোট, মহাজোট রাজনীতিতে অতিপরিচিত শব্দ। বড় দলগুলো নানা আন্দোলন সংগ্রামে ছোট ছোট দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে। এরপর নির্বাচনের আগে নির্বাচনী জোট হয়। বিগত নির্বাচনগুলোতেও জোট, মহাজোটের খেলা দেখা গেছে। কিছু কিছু দল রয়েছে যাদের ঢাকাকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এসব ক্ষেত্রে দলীয় প্রধান মানুষের কাছে জনপ্রিয় হলেও নিজ এলাকার ভোটারদের কাছে তার দলের প্রতীক খুব বেশি পরিচিত না। তাই বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট হলে ছোট দলগুলোর প্রার্থীরা বড় দলের প্রতীকে ভোটে লড়াই করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আবার অনেকে নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে চান। এক্ষেত্রে প্রার্থীর আসনকেন্দ্রিক জনপ্রিয়তাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
কিন্তু এবার অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) পরিবর্তন এনেছে। গত বৃহস্পতিবার আরপিও (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে কোনো দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও ভোটের লড়াই করতে হবে নিজ দলীয় প্রতীকে। নতুন এই আদেশ আগামী নির্বাচনে জোট গঠন ও ভোটের লড়াইয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন রাজনীতিবিদরা।
তবে নতুন সিদ্ধান্তকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটার সুবিধা হচ্ছে ভোটাররা অন্তত প্রার্থীর দলীয় পরিচয় জানতে পারবে। শুধু প্রতীক না প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা বিচারেও ভোটের লড়াই হবে। বড় দলের প্রতীকে অনেক সময় দুর্বল ও অজনপ্রিয় প্রার্থীও প্রতীকের কারণে বিজয়ী হয়ে যেত; সেটা এখন থেকে আর হবে না।
রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জোটের সমীকরণে দারুণ প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের মতে, ছোট দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে বড় দলের প্রতীকে ভোট করতেন। অনেকে নিজ দলের প্রতীকেও বিজয়ী হয়েছেন সেই রেকর্ডও রয়েছে। কিন্তু সেই বিজয় ছিল প্রার্থীর নির্বাচনী আসনের প্রভাবের ওপর।
বর্তমানে ইসির নিবন্ধন পাওয়া ৫০টির বেশি রাজনৈতিক দল থাকলেও ভোটারদের কাছে বেশি পরিচিত দলে ৪-৫টি। ভোটারদের কাছে প্রতীক হিসেবে বিএনপির ধানের শীষ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল। যেহেতু আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই তাই নৌকা প্রতীক নিয়ে আলোচনাও নেই।
এর বাইরে ছোট ছোট যে দলগুলো রয়েছে এবং আরও নতুন যেসব দল নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে তাদের প্রতীক এখনও ভোটারদের কাছে খুব বেশি পরিচিত না। তাই ছোট দলগুলোর শীর্ষ নেতারা এতদিন জোটের প্রার্থী হওয়ার মাধ্যমে বিজয়ের যে সম্ভাবনা দেখছিলেন তাতে মারাত্নক ভাটা পড়তে পারে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদরা। পাশাপাশি জোট গঠন নিয়েও শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এতে সরকার গঠনও জটিল সমীকরণে পড়তে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
তবে এতে কোনো অসুবিধা দেখছেন না বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি তো কোনো অসুবিধা দেখি না। এতে সমস্যাটা কী?’ তবে দলটির স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এর বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ছোট দলগুলো জোটভুক্ত হয় শরিক বড় দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুবিধার জন্য। অথবা নিজস্ব প্রতীকেও করতে পারে। এটা থাকা উচিত। তা না হলে ছোট দলগুলো জোটভুক্ত হবে কেন?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও ভিন্নমত পোষণ করেছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়ার দরকার ছিল। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ধরনের আইন সংশোধন করার আগে রাজনৈতিক দলের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি।
জোটভুক্ত নির্বাচন করার পরও নিজ দলের প্রতীকে ভোটের লড়াই করতে গেলে ছোট দলগুলো সমস্যা পড়বে। বড় দলগুলোর পরিচিতি রয়েছে তাদের প্রতীকেরও পরিচিত রয়েছে। সুতরাং সমস্যায় পড়বে ছোট দলের যারা জোটের প্রার্থী হয়ে ভোট করবেন।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার চাইলে নিজের ইচ্ছামতো একটা জিনিস চাপিয়ে দিল এটা হাসিনা সরকারের সময়ে হতো। সেই একই জিনিস অন্তর্বর্তী সরকার করল। এই ম্যানডেট তাদের কে দিল? এ বিষয়ে আমরা কিছু করব কিনা দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে।
আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে বলে জানান গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, দুটো অপশনই থাকা উচিত। কেউ যদি নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে চায় সেটা করবে। আবার কেউ যদি জোটবদ্ধ হয়ে যে জোটের প্রার্থী সেই দলের প্রতীকে ভোট করতে চায় করবে, এই স্বাধীনতা ছিল, এটা রাখা উচিত।
নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গণসংহতি আন্দোলন। এর প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত- আমরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করব। অন্য দল যদি অন্য কোনো দলের প্রতীকে ভোট করতে চায় সেই সুযোগ রাখা উচিত।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, সংশোধিত আরপিওতে যেটা করা হয়েছে অবশ্যই ভালো দিক। আগে ছিল জোটের প্রার্থীদের অন্য দলের প্রতীকে ভোট করায় ভোটাররা প্রার্থীর দলীয় পরিচয় সম্পর্কে অবগত থাকত না। এবার যেটা করা হয়েছে খুবই সুন্দর হয়েছে। জোটের প্রার্থী হলেও প্রার্থীর দলীয় প্রতীক ও দলের আদর্শ লক্ষ্য সম্পর্কে ভোটররা অবগত হতে পারবেন। এটা অবশ্যই ভালো দিক।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারির মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের আছে মাত্র সাড়ে তিন মাসের মতো সময়। এই সময়ে আরপিও সংশোধন করে যেটা করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে আগামী নির্বাচনে জোটভুক্ত হওয়া ছোট দলগুলোর জন্য বাধা হতে পারে। তাই রাজনৈতিক নেতারা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার গঠনের স্বার্থে জোট হওয়াটা জরুরি বলে মনে করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।