ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত দেওয়ার নামে রোগীকে কী দেওয়া হচ্ছে? সরকারি নীতিমালা মানা হচ্ছে কি না এবং শুধু গ্রুপ ম্যাচিং করে দেওয়া হচ্ছে কি না—তা দেখার যেন কেউ নেই। এমনই অবস্থা চলছে রক্ত বেচাকেনায়। বেশির ভাগ বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলোতে সরকারি নিয়ম না মেনে উচ্চ মূল্যে রক্ত বেচাকেনার বাণিজ্য চলছে দিনের পর দিন। নরমাল স্যালাইন মিশিয়ে এক ব্যাগ রক্তকে একাধিক ব্যাগ করে বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৪৫২টি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। অবৈধভাবে রয়েছে এর কয়েক গুণের বেশি। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেই রক্ত বেচাকেনা শুরু করে দেয়। এ ধরনের ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যাও কম নয়। অনেকে আবেদন ছাড়াই ব্লাড ব্যাংক খুলে রক্ত বেচাকেনা করে যাচ্ছে মাসের পর মাস। অনুসন্ধানে এ ধরনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের আশপাশে এবং অলিগলিতেও ব্লাড ব্যাংকের সাইনবোর্ড ঝুলছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে তাকে রক্তই দিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সরকারের নীতিমালা না মেনে রক্ত রোগীকে দেওয়া বিপজ্জনক। এভাবে রক্ত নিলে সংক্রামক ব্যাধি এমনকি প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। রক্ত বেচাকেনার ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা মানা হলেই সেই রক্ত নিরাপদ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বেশির ভাগ বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক পেশাদার ডোনারের (রক্তদাতা) রক্ত কেনাবেচা করে থাকে। ব্যাংকগুলো উচ্চমূল্যে রক্ত নিয়ে থাকে রোগীর কাছ থেকে। কিন্তু পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে অনেকেই মাদকাসক্ত। তাদের অনেকেই সিফিলিস, গনোরিয়া, এইচআইভি (এইডস) এবং হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত। বেশির ভাগই নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে। রক্ত বিক্রি করেই অনেকে মাদক কেনার টাকা যোগাচ্ছে।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ডোনার কিংবা পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন থেকে রক্ত সংগ্রহ করার আগে হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি (এইডস) পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে, তার দেহের রক্ত নিরাপদ কি না। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর ক্রসম্যাচিং শেষে ব্লাড গ্রুপ মেলাতে হবে। তারপর রোগীর দেহে রক্ত দেওয়ার নিয়ম। বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক হলে সেক্ষেত্রে নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। নিবন্ধন ছাড়া অবৈধ ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত ক্রয় করা রোগীর জন্য বিপজ্জনক বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর ব্লাড ব্যাংকসমূহে সরকার নির্দেশিত প্রোটোকল মেনে রক্ত দেওয়া হয়ে থাকে। তবে সরকারি হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য বেশি। তারাই রোগীদের সরকারি ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত ক্রয় না করার জন্য নানা ধরনের প্রলোভন দিয়ে প্রভাবিত করে থাকে। যে কারণে অনেক রোগী নিজের স্বজনদের থেকে কিংবা সরকারি ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকে। রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে রোগীরা বেশির ভাগই দালালদের খপ্পরে পড়ে। তারাই টাকা দিয়ে ক্রয় করছে সংক্রামক ও মরণব্যাধিতে আক্রান্ত পেশাদার ডোনারের রক্ত। এ রক্ত শরীরে দেওয়ার পর ৯৯ ভাগ রোগী ঐ সব মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশঙ্কা। তবে অনেক রোগী ও তার স্বজনরা সচেতন। নিরাপদ হিসেবে আত্মীয়স্বজনদের থেকে রোগীকে রক্ত দেওয়া হয়ে থাকে। অনেক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বড় বড় হাসপাতালে অনুরূপ ব্লাড দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে রক্ত কেনাবেচার নামে বেশি নৈরাজ্য চলছে।
মহাখালী গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. এনামুল করিম বলেন, ‘পেশাদার ডোনারের রক্তে সংক্রামক ব্যাধির ভাইরাস থাকা স্বাভাবিক, তাদের রক্ত রোগীকে দিলে একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সরকারি নির্দেশনা মেনে রোগীকে রক্ত দেওয়া নিরাপদ।’
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এম এন হুদা বলেন, ‘হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস এবং এইচআইভি (এইডস) পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলো এসব পরীক্ষা করছে কি না, তা নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার। পেশাদার রক্তদাতার রক্ত কেনাবেচা করা বিপজ্জনক। তাদের বেশিসংখ্যক মাদকাসক্ত। এছাড়া, তাদের অনেকে খোচপাঁচড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। ইউরোপ, কানাডা ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই রোগীর জন্য সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন ব্যবস্থাপনা শত ভাগ নিশ্চিত থাকতেই হবে। এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। রোগীর জন্য শতভাগ নিরাপদ ব্লাড নিশ্চিত হলেই কেবল চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া হয়ে থাকে। নিয়মের কোনো ধরনের ব্যত্যয় হলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কবির চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের নির্দেশিত প্রটোকলের পাশাপাশি থাকতে হবে ব্লাড ব্যাংকের নিবন্ধন। বাংলাদেশে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও রোগীকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে একই প্রটোকল রয়েছে। প্রটোকল মেনেই নিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত দেওয়া নিরাপদ।’
গ্যাস্ট্রোলিভারের অন্যতম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘সরকারের নির্দেশিত প্রটোকলের কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে রোগীর জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘২৬০০ বেডের এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী থাকে চার সহস্রাধিক। এই হাসপাতালে রক্তের চাহিদা বেশি। গাইনি বিভাগে অপারেশন থিয়েটারের পাশেই রক্ত সংগ্রহ করার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। রোগীর স্বজনরা সেখানে দ্রুত ব্লাড দিতে পারেন। রোগীর জন্য বাইরে থেকে রক্ত কেনার প্রয়োজন হয় না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার বাইরে ব্লাড ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের অফিস ও জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের অফিসের নিয়মিত মনিটরিং করার নির্দেশনা থাকলেও তা করা হয়নি। এমন তথ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া গেছে।





















