একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন সে নিঃশব্দ এক জ্যোতি।
সে কথা বলতে জানে না, চাহিদা প্রকাশ করতে জানে না, কিন্তু একজন মা তার হৃদয়ের গোপন ভাষা দিয়ে সেই নীরবতাকে বোঝেন।
শিশুর কান্না মানেই তার ক্ষুধা, শিশুর নিঃশ্বাসে বদলে যাওয়া সুর মানেই তার ব্যথা।
মা বুঝে যান, অনুভব করেন, এবং উত্তর দেন — শব্দে নয়, প্রেমে।
রাতের পর রাত, শত শত নিদ্রাহীন প্রহর তিনি কাটান কেবল সন্তানের নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা তা দেখতে।
বুকের দুধে শুধু আহার নয়, তিনি দেন জীবনের প্রথম আশীর্বাদ — নির্মল আত্মিক সংযোগ।
সেই মুহূর্তে মা আর নারী থাকেন না, তিনি হয়ে ওঠেন অস্তিত্বের আদি উৎস,
যেখানে মানবজন্ম ও সৃষ্টির প্রার্থনা একাকার হয়ে যায়।
দিন যায়, শিশু বড় হয়, মায়ের দেহ ক্ষয় হতে থাকে,
কিন্তু সেই ভালোবাসার নদী কখনও শুকায় না।
একদিন সন্তান হয়তো অন্যদিকে চলে যায়, নিজের পৃথিবী বানায়,
ব্যস্ততায় হারিয়ে ফেলে মায়ের পুরনো মুখ।
তবু মা তাকিয়ে থাকেন — একান্ত নীরব প্রার্থনার মতো।
তার প্রত্যাশা একটাই — সন্তান যেন ভালো থাকে, নিরাপদে থাকে।
প্রতিদান? না, মা প্রতিদান চান না।
তিনি জানেন, সন্তান কখনও সেই ঋণ শোধ করতে পারবে না।
কারণ এক মায়ের ত্যাগের হিসাব কেবল পৃথিবীর সীমায় মাপে না —
তার ছায়া ছুঁয়ে যায় আত্মার অনন্ততা।
সেইজন্যই তো বলা হয়, সন্তানের দেহে মায়ের ছাপ রয়ে যায়,
শুধু রক্তে নয়, চেতনায়।
মা নিজের জীবনের রস দিয়ে সন্তানকে গড়ে দেন,
আর সেই রস থেকে তৈরি হয় এক সেতুবন্ধ —
যা এই পৃথিবী ও পরকালের মাঝেও টিকে থাকে।
সন্তানের প্রথম আশ্রয় যে মাতৃগর্ভ, সেটিই আসলে মানবজাতির প্রথম মসজিদ, মন্দির মন্দির।
সেখানে মা-ই পুরোহিতা, মা-ই প্রথম শিক্ষাগুরু।
তিনি কেবল সন্তান জন্ম দেন না, জন্ম দেন প্রেমের নিত্যচক্র — যা কখনও শেষ হয় না।
তাই তো একজন মায়ের প্রতিদান দেওয়া যায় না — না এই ভুবনে, না পরভুবনে।
কারণ মা সেই আলো, যা মৃত্যুকেও অতিক্রম করে টিকে থাকে সন্তানের শিরায়, অন্তরে, নীরব প্রার্থনায়।
“মায়ের নিঃশব্দ ভালোবাসাই মানবজাতির প্রথম ভাষা, আর শেষ প্রার্থনা।
যেখানে সব সম্পর্ক শেষ হয়, সেখানেও মায়ের ছায়া থেকে যায়—আলো হয়ে।”
লেখিকা কবি সাজেদা আলী হেলেন