সোমবার, ০৭:২৩ পূর্বাহ্ন, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

জুলাই সনদ : এনসিপি এখন কী করবে

হাসান মামুন
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫
  • ১৩ বার পঠিত

দীর্ঘ সংস্কার আলোচনা শেষে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হলো শুক্রবার। দেখা গেল, এ বিষয়ে সবচাইতে উৎসাহী রাজনৈতিক দলটি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত। কেন স্বাক্ষর করবে না– এটা অবশ্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্র গ্রহণ অনুষ্ঠানে এনসিপি অংশ নিলেও এর নেতৃস্থানীয় ক’জন কক্সবাজারে চলে গিয়েছিলেন। সে ঘটনা ঘিরে গুজবও ছড়ায়। জানা যায়, ঘোষণাপত্রটি মনঃপূত হয়নি বলে তারা সেই সময়ে সাগরতীরে থাকাকে শ্রেয় মনে করেছিলেন। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অবশ্য তারা বর্জন করেছেন ঘোষণা দিয়েই।

এনসিপির কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে জামায়াতে ইসলামীও বলছিল, বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষরের কোনো অর্থ নেই। সংস্কার আলোচনায়ও দল দুটির অবস্থান ছিল অনেক ক্ষেত্রে কাছাকাছি। তাই ধারণা করা হচ্ছিল, উভয় দলই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না। এর মাধ্যমে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে এবং বিএনপিকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারে। জামায়াত নেতারা বলছিলেন, অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও সনদে স্বাক্ষর নাও করতে পারেন। তারা এখন বলছেন, নিজস্ব রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে সনদে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এনসিপি নেতারা এখন জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তব্য রাখছেন। এ বিষয়ে দলটির নেতা নাহিদ ইসলামের ফেসবুকে তির্যক পোস্ট বেশি আলোচিত। জামায়াত নেতারাও কঠোর প্রত্যুত্তর দিতে দ্বিধা করছেন না। গণঅভ্যুত্থানের পর জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে যে সখ্য কারও নজর এড়ায়নি; সেটা এর ভেতর দিয়ে কার্যত ভেঙে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। ঘটনাধারায় স্পষ্ট, এনসিপির প্রত্যাশা পূরণ করেনি জামায়াত।

এদিকে জামায়াত সংস্কার প্রক্রিয়ায় থাকার পাশাপাশি সংসদের নিম্নকক্ষেও পিআর চালুর দাবিতে আছে আন্দোলনে। আরও কিছু ইসলামপন্থি দল এ ইস্যুতে তাদের পাশে থাকলেও এনসিপি নেই। তারা শুধু উচ্চকক্ষে পিআর চাইছে। এ ক্ষেত্রে এনসিপির অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও বিএনপির কাছাকাছি। এ কারণে জামায়াতও মনে হয় দলটির ওপর বিরক্ত।

গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের একাংশের নেতৃত্বে এনসিপি যে সময়ে ও যেভাবে গঠিত হয়, তাতে অভিযোগ উঠেছিল দলটি ‘কিংস পার্টি’ কিনা। প্রধান উপদেষ্টা তাদের বিষয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বক্তব্য দেওয়াতে ওই অভিযোগ দানা বাঁধে। সরকার থেকে বেরিয়ে এসে নাহিদ ইসলাম এনসিপি গঠন করলেও তাঁর দুই রাজনৈতিক সহকর্মী এখনও উপদেষ্টা পরিষদে বহাল। এনসিপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সমর্থনমূলক পোস্টও দিতে দেখা গেছে তাদের। তবে দলটির একাধিক কর্মসূচি ব্যাপক মানুষের সমর্থন তো নয়ই; বিএনপিরও সমর্থন পায়নি। বিএনপি তো মাঠে থাকা সবচাইতে বড় দল। গণঅভ্যুত্থানেও তাদের ভূমিকা কোনো অংশে কম ছিল না। এ অবস্থায় এনসিপি হয়তো ভেবেছিল, সরকারের একাংশ ও জামায়াত তার পাশে রয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানে নাহিদ ইসলামসহ এনসিপি নেতাদের নেতৃত্ব কেউ অস্বীকার করে না। অচেনা মুখ হলেও তাদের ডাকে সর্বস্তরের মানুষ কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে নেমে আসতে দ্বিধা করেনি। এর সফল পরিণতিতে সরকার গঠনেও বড় ভূমিকা রাখেন ওই ছাত্র-তরুণরা। উপদেষ্টা পরিষদে তাদের ক’জনের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও তখন গুরুতর প্রশ্ন ওঠেনি। তবে সম্ভবত ভুলের সূত্রপাত হয় তখনই।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণ তো চাট্টিখানি কথা নয়। এরপর আবার শুরু হয় ‘মাস্টারমাইন্ড’ বিতর্ক। আসে ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের পালা। এমন অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের অবশ্য অতীতেও হয়েছে। কোনো কোনো মহলের অস্বস্তি সত্ত্বেও অধিকাংশ নাগরিক আসলে দেখতে চাইছিল এনসিপির হাতে নতুন রাজনীতি। ‘নতুন বন্দোবস্ত’ কথাটা তারাই প্রথম সামনে এনেছিলেন বলে দলটির কাছে নতুন রাজনীতির প্রত্যাশা ছিল স্বাভাবিক। এর কতটা দাম দিতে পেরেছে দলটি, সেটাই বড় প্রশ্ন আজ।

জামায়াতের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এনসিপির। এনসিপির তরফে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার ‘আখের গোছানো’ এবং তাদের ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এগুলো মারাত্মক অভিযোগ। ইসির বিষয়েও তাদের অভিযোগ তীব্র। পছন্দের প্রতীক পেয়ে গেলেই তারা সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন বন্ধ করবেন কিনা– সেটাই বা কে জানে! সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তাদের তিক্ততা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে রাখা বক্তব্যে। আর বিএনপির বিষয়ে তো শুরু থেকেই তারা সমালোচনামুখর। হালে জামায়াতের সঙ্গেও দৃশ্যমান তাদের সম্পর্কের অবনতি। এসবের পেছনে কী তাদের রাজনৈতিক বিবেচনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

এনসিপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত কম গুরুতর অভিযোগ ওঠেনি। ‘পুরোনো বন্দোবস্ত’ মেনেই তারা দল পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগের সদুত্তর মেলেনি এখনও। জনপ্রশাসনে হস্তক্ষেপসহ তাদের একাংশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো কিন্তু যথেষ্ট অস্বস্তিকর। ক্ষমতার সংস্পর্শে না গিয়ে দল গঠন করে মাঠে থাকলে এনসিপি বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়তো ভিন্নই হতো। সেই সুযোগ তারা দেননি।

এমন ষড়যন্ত্রতত্ত্বও রয়েছে, রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা ছাত্র-তরুণদের ভাবমূর্তি বিনষ্টের প্রক্রিয়াও চলমান। এর আওতায়ই নাকি ঘটছে সবকিছু। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে গেলে এনসিপিকে তো সে বিষয়ে সতর্ক থেকেই এগোতে হবে। আদর্শগত অবস্থানও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করতে পারেনি দলটি। নিজেদের ‘মধ্যপন্থি’ বলে দাবি করলেও অনেকে শুরু থেকেই তাদের মনে করছে ‘জামায়াতের বি-টিম’। সে কারণেই নাকি স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আর এ প্রচেষ্টায় শেষে জামায়াতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি নাকি হয়েছে।

হালে চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত শিক্ষার্থীদের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পাশাপাশি এনসিপি সমর্থিতদেরও হয়েছে ভরাডুবি। এটা অনেকের কাছেই ছিল অবিশ্বাস্য। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের ভেতর থেকে গঠিত দলের কেন এমন পরিণতি হবে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে?

অনেকে বলেন, জামায়াতের কুশলী ছাত্র সংগঠন তাদের কৃতিত্ব আত্মসাৎ করেছে। সেটা সত্য হলে এনসিপির ভেতরে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। জুলাই সনদ অনুষ্ঠান বর্জন করে একে ‘গণপ্রতারণা’ বলে অভিহিত করায় তারই চরম প্রকাশ ঘটেছে। সরকার অবশ্য চায়, নতুন করে বর্ধিত সময়ে এনসিপি এতে স্বাক্ষর করুক। এনসিপিসহ বামপন্থি কিছু দলই কেবল জুলাই সনদে স্বাক্ষর থেকে দূরে রয়েছে। তারা সবাই সংস্কার আলোচনায় ছিল।

ভোটের বেশি দেরি নেই। এনসিপি অবশ্য ‘গণভোট’ আর ‘গণপরিষদ’ গঠনেই বেশি জোর দিচ্ছে। ‘নতুন সংবিধান’ গ্রহণে দলটি ব্যগ্র। অতি দ্রুত এসব বিপ্লবাত্মক লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েই দলটি সংকটে পড়ল কিনা, সেটা হয়তো অচিরেই স্পষ্ট হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com