পরমাণু বোমা তৈরির জন্য সমৃদ্ধকরণের পর্যায় ৯০ শতাংশে উন্নীত হতে হবে। এই অবস্থায় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বারবার বলেছেন, ‘আমরা জনকল্যাণে ইউরেনিয়ামের ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই, মারণাস্ত্র তৈরি করার জন্য নয়।’ কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তাতে কখনোই কান দেননি। তিনি প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির ব্যাপারে মন্তব্য করে আসছিলেন। তা ছাড়া ইরান যখন পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার প্রায় দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই কেন নেতানিয়াহু ইরানে হামলা শুরু করলেন? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরে গণমাধ্যমের অনেকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর নেতানিয়াহুর ষোলো আনা ভরসা ছিল না। তাঁর একটি ধারণা জন্মেছিল যে ট্রাম্প তাঁকে বাদ দিয়ে পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেলতে পারেন। কিন্তু নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য ছিল ইরানের সব পরমাণু স্থাপনা সমূলে ধ্বংস করা।সাদ্দাম হোসেনের জীবদ্দশায় ১৯৮১ সালে ইরানের অসিরাক পরমাণু রিঅ্যাক্টরে যা ঘটেছিল, নেতানিয়াহু তারই পুনরাবৃত্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হওয়ার ফলে কোনো একটি বা দুটি কেন্দ্রে অকস্মাৎ জঙ্গি বিমান থেকে হামলা চালিয়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চেয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যসহ সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। সে কারণে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে কেউ কাউকে সম্পূর্ণভাবে আস্থায় নিতে পারছিলেন না। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ইসরায়েলি পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (AIPAC) নামে একটি শক্তিশালী ইহুদি লবি। তাদের পাশ কাটিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনীতিকের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে কিছুই করা সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইসরায়েলে ইহুদিবাদীরা এতই প্রভাব ও বিত্তশালী যে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের পক্ষেই খুব সহজ হবে না। সেসব কারণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে তাঁর ইচ্ছামাফিক সব কাজ করা সম্ভব ছিল না। ফিলিস্তিন, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রবল চাপের মুখে তাঁকে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। তা ছাড়া ট্রাম্প নিজেও একজন বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী বলে ধারণা করা হয়। তবে আরববিশ্বের অর্থ-বিত্ত এবং মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি সম্পদের কারণে তাঁকে অনেক সময় বিভিন্ন অভিনয় করতে হয় বলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।কট্টর ইহুদিবাদী নেতা নেতানিয়াহুর বিনা ঘোষণায় ইরান আক্রমণের পর তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘটনার নিন্দা জানায় বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত সম্পূর্ণ নীরব। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এই যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতা করতে আহবান জানিয়েছেন। পুতিনও এ ব্যাপারে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। তা ছাড়া ইরানের বুশহরে নির্মাণাধীন একটি পরমাণু জ্বালানি প্রকল্পে প্রচুর রুশ কারিগরি ও প্রযুক্তি বিষয়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী কাজ করেন বলে পুতিন নেতানিয়াহুকে জানিয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট উল্লিখিত কর্মজীবীদের পূর্ণ নিরাপত্তা দাবি করেছেন। তবে এরই মধ্যে ইরানের নাতাঞ্জ, ফার্দো, খনদানসহ তেহরান, ইসফাহান ও অন্য এলাকায় স্থাপিত চারটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পরমাণুকেন্দ্রে ইসরায়েল ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইউরেনিয়াম মজুদকৃত বা সংরক্ষিত স্থানগুলো এখনো তেমন ঝুঁকির মুখে পড়েনি বলে সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে। সেসব বিষয়ে ইরানের রাষ্ট্রপ্রধান মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিন কয়েক দফায় কথা বলেছেন। তা ছাড়া রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ইরানের পাশে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ইসরায়েলের ইরান আক্রমণের প্রাক্কালে বিভিন্ন হুমকি-ধমকির মুখে চীন ইরানে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যথাশীঘ্র যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনতে হন্যে হয়ে উঠেছিলেন। এর পাশাপাশি কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদি ধনকুবের, রাজনীতিক ও গণমাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পশ্চিমা জগৎ অর্থাৎ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানিও ইসরায়েলের পাশে রয়েছে। আর মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আমিরাত, কাতার, কুয়েত এবং তুরস্কও মার্কিন প্রভাবের বাইরে যাবে না। তুরস্ক এখনো ইসরায়েলকে তেল সরবরাহ করে যাচ্ছে। প্রয়োজনে তারা সবাই ইসরায়েলকে হয়তো অস্ত্রশস্ত্রও সরবরাহ করবে। ব্রিটিশ রণতরি কুইন এলিজাবেথ-২ এরই মধ্যে ইরানের দিকে রওনা দিয়েছে জঙ্গিবিমানের বহর নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধের জন্য দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে একটি সামরিক ঘাঁটি চেয়েছে ব্রিটেনের কাছে। পক্ষান্তরে এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে ইরান এখনো চীন কিংবা রাশিয়ার কাছে কোনো সাহায্য চায়নি। তারা একাই তাদের বিভিন্ন পাল্লার রকেট ও হাইপারসনিক মিসাইল নিয়ে ইসরায়েলে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন হলে ইরান তার হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে, যার মাধ্যমে বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এতে পারস্য উপসাগর এবং এমনকি লোহিত সাগরেও জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
এই যুদ্ধ অতি শীঘ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে না পড়লেও আঞ্চলিকভাবে তা বিস্তৃত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তেলের মূল্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অর্থনৈতিক মন্দায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে সামরিক ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ হাজার নিয়মিত সেনা রয়েছে। ইরান নিরুপায় হলে তাদের ওপরও হামলা চালাতে বাধ্য হবে বলে অনেকে মনে করেন। যে ইসরায়েল পরমাণু বোমা তৈরির সন্দেহে ইরানের ওপর সর্বাত্মক সামরিক হামলা শুরু করেছে, তাদের হাতে রয়েছে ৯০টি পরমাণু বোমা এবং ২০০টির ওপর তারা তৈরি করতে পারে অল্প সময়ের মধ্যে। এই তথ্য প্রদান করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। তবে ঘটনা যা-ই হোক, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতির চেহারা সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে।
ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ শুরুর এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে কোনো কৈফিয়ত চায়নি। তাই অনেক সংবাদ বিশ্লেষক বলেন, মার্কিনরা ইহুদি জনগোষ্ঠী এবং ইসরায়েলের কাছে একরকম জিম্মি হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইহুদিবাদী ইসরায়েলের হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কি না সে জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছেন। হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে ইরানকে পরমাণু বোমা তৈরির খায়েশ ও হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। সে জন্য জেনেভার জার্মান দূতাবাসে গত শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ইরানকে ইউরোপের দুই পরাশক্তি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এবং জার্মান কূটনীতিকদের সঙ্গে বসার আহবান জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইরান পরমাণু বোমা না বানানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার ত্যাগ করতে রাজি নয়। এতে তারা তাদের নিরাপত্তা কিংবা প্রতিরক্ষা সামর্থ্য সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলবে বলে উল্লেখ করেছে। তা ছাড়া ইরান বলেছে, তারা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর থেকে যাবতীয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। এখন দেখা যাক, ইসরায়েল-মার্কিন জোট শেষ পর্যন্ত কী করে? ইসরায়েল মনেপ্রাণে চায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চুক্তি স্বাক্ষর না করে চিরতরে ইরানকে অকার্যকর করে দেওয়ার জন্য আক্রমণ চালান। এতে ইসরায়েল সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ও ইরানের জ্বালানিসম্পদের ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশের ওয়াশিংটন দূতাবাসে নিযুক্ত সাবেক মিনিস্টার