দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ পেয়েও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড’ (বাপেক্স)। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটির কয়েক কর্মকর্তার যোগসাজসে গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সের থ্রিডি ও টুডি সাইসমিক প্রকল্পে ৬১০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। সেই সঙ্গে ভূয়া কাগজপত্রে ভুঁইফোর প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
এসব বিষয়ে গত ১০ মে পর্যন্ত বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দপ্তর ছাড়াও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানের দপ্তরেও লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে দফায় দফায়। তদন্তে কোটি কোটি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে পেট্র্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। বাপেক্সের অভিযুক্ত উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও থ্রিডি সাইসমিক প্রকল্পের পরিচালক মেহেরুল হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করেছে কমিটি। প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতির সত্যতা পেয়ে তথ্যপ্রমাণসহ তা তদন্ত প্রতিবেদনসংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছে বাপেক্স গঠিত তদন্ত কমিটিও; কিন্তু এই দুর্নীতির নেটওয়ার্ক এতটাই মজবুত যে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
তবে বাপেক্সের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে দুদক।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে সংস্থাটি। গত ৩১ মার্চ বাপেক্সের থ্রিডি ও টুডি সাইসমিক প্রকল্প ও রূপকল্প-প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আট উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এবং বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) পদমর্যাদার ১০ কর্মকর্তাকে তলব করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম। এদের মধ্যে কয়েক কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ দুদক কার্যালয়ে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। কারও কারও বিদেশে যাওয়াসহ কর্মস্থল ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ওপর কোনো অডিট বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়ে থাকলে তা দুদকের কাছে হস্তান্তরের জন্য বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পগুলোর ভৌত এবং আর্থিক অগ্রগতিসংক্রান্ত তথ্যাদি চাওয়া হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল এসব নথিপত্র দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়নি বাপেক্স। এসব প্রকল্পে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আর্নিব এন্টারপ্রাইজেরও’ যাবতীয় ফাইল তলব করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
প্রকল্পের কাজ না করে কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের পরিপ্র্রেক্ষিতে দুদকে তলব করা কর্মকর্তাদের তালিকায় আছেন- বাপেক্সের ডিজিএম ও থ্রিডি সাইসমিক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মেহেরুল হাসান, ডিজিএম ও টুডি সাইসমিক প্রকল্পের পিডি সাবিহা আক্তার খানম, ডিজিএম (প্রকৌশলী) ও রূপকল্প-১ এর প্রকল্পের পরিচালক মিজানুর রহমান চৌধুরী, ডিজিএম (খনন) ও রূপকল্প-২ প্রকল্পের পিডি মো. জহুরুল ইসলাম; ডিজিএম ও রূপকল্প-৩ এর প্রকল্পের পিডি মিজানুর রহমান; ডিজিএম (খনন) ও রূপকল্প-৪ এর পিডি ফজলুর রহমান; ব্যবস্থাপক (রসায়ন) ও রূপকল্প-৫ এর পিডি তোফায়েল আহমেদ শিকদার; ব্যবস্থাপক (ভূপদার্থ) ও রূপকল্প-৯ (২-ডি সাইসমিক) এর পিডি মো. তারিকুল ইসলাম; ডিজিএম (ভূপদার্থ) ও ২ডি সাইসমিক সার্ভে ওভার এক্সপ্লোরেশন ব্লক-৩বি, ৬বি এবং ৭ এর পিডি মো. মইনুল হোসেন এবং ডিজিএম (প্রকৌশলী) ও বাপেক্স কর্তৃক একটি ড্রিলিং রিগ এবং ওয়ার্ক ওভার রিগসহ অন্যান্য সহায়ক যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত প্রকল্পের পিডি মো. আব্দুর রউফ।
তদন্তে অভিযোগ প্রমাণের পরও জড়িতের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে গতকাল পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান আমাদের সময়কে বলেন, প্রকল্পগুলোয় অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করা হয় আমি এখানে যোগদানের আগেই। ফলে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। বিষয়টির বিস্তারিত আমি অবগত নই। কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি বাপেক্সের কয়েক কর্মকর্তাকে দুদক তলব করেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে দুদক এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কিছুই চায়নি। তদন্তের স্বার্থে দুদক কোনো তথ্য চাইলে পেট্রোবাংলা সহায়তা করবে।
জানা গেছে, দুদক যাদের তলব করেছে, তাদের অনেকেই বিনা টেন্ডারে বারবার একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে শত শত কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে ডিজিএম মেহেরুল হাসানের বিরুদ্ধে। বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেওয়া, শ্রমিক নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে ২৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার সিন্ডিকেট। তিনি টেন্ডার ছাড়াই আর্নিব এন্টারপ্রাইজকে বিপুল অঙ্কের টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। এসব কাজে অনিয়মের বিষয়ে তদন্তে উঠে এসেছে- ডিজিএম মেহেরুল হাসান ও আর্নিব এন্টারপ্রাইজ মিলে ২৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকায় ৯টি স্থানে জরিপ করেছে। এসব জায়গার মধ্যে কোনোটি বড়, কোনোটি অনেক ছোট। জায়গা যাই হোক না কেন, প্রতিটির জন্য সমান যন্ত্রপাতি ও শ্রমিক দেখানো হয়েছে। ফলে ব্যয়ের হারও সমান হয়েছে, যাতে অনিয়মের ছাপ স্পষ্ট। অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করে বাপেক্স।
অভিযোগের বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, তাদের কয়েক কর্মকর্তার বিষয়ে দুদক কিছু নথি চেয়েছে, যা সরবরাহ করা হয়েছে। যেহেতু দুদক অভিযোগ তদন্ত করছে, সেহেতু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা বিভাগীয় তদন্ত করে থাকি। তদন্তে বাপেক্সের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণ হলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হয় না; এ ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটবে না।
বাপেক্স সূত্র জানায়, বিনাটেন্ডারে ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) ভূকম্পন জরিপের কাজ করেছে একটি কোম্পানি। প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেছে তদন্ত কমিটি। সারাবছর ৯টি স্থানে দৈনিক ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করেছেন বলে দাবি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের। এমনকি ৯টি জরিপেই সমপরিমাণ যানবাহনের ব্যবহার দেখিয়েছে তারা। ২৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজ করেছে বাপেক্স। এর ৯১ ভাগের কাজ শেষ হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাকি ৯ ভাগের জন্য বরাদ্দ ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ হিসাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- সার্বক্ষণিক কর্মরত জনবল ছিল ১২০০ জন। এতে জনবল বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। আর যানবাহনের ব্যয় দেখিয়েছে ৮০ কোটি টাকা। তবে জরিপ এলাকাগুলোর মধ্যে ১৫০, ২০০, ৩০০ ও ৬০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাও ছিল। সেখানেও একই শ্রমিক ও একই পরিমাণ যানবাহন দেখানো হয়েছে। এদিকে প্রকল্পে নিয়ম না মেনে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রথম ধাপে ২ কোটি ৮০ লাখ ও দ্বিতীয় ধাপে ১৪ কোটি ৮ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও সেগুলো আসেনি। এ ছাড়া টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৫৮ কোটি ৫০ লাখ এবং ১৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বাপেক্সের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও থ্রিডি সাইসমিক প্রকল্পের পরিচালক মেহেরুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়; সাড়া না দেওয়ায় খুদেবার্তা পাঠিয়েও মন্তব্য চাওয়া হয়; কিন্তু গতকাল রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাড়া দেননি তিনি। এর আগে দুই দিন উপ-মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল হাসানের দপ্তরে গেলেও তার দেখা মেলেনি।
দুদকে দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বাপেক্সে থ্রিডি ও টুডি সাইসমিক প্রকল্পে পেট্রোবাংলার তদন্তে ৬১০ কোটি টাকার ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পরে। বাপেক্সের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ডিজিএম মেহেরুল হাসানসহ তার বিশাল সিন্ডিকেট বাপেক্সের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অর্থ বরাদ্দ করে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের ভুয়া কাগজপত্র ও লাইসেন্স বিহীন প্রতিষ্ঠান আর্নিব এন্টারপ্রাইজকে সঙ্গে নিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে গোপনে কাজ দিয়ে ভুয়া বিলপত্র তৈরি করে, ভুয়া এলসির মাধ্যমে বৈদেশিক যন্ত্রপাতির ক্রয় দেখিয়ে নষ্ট পুরনো যন্ত্রপাতি দেশ থেকে ক্রয় করে, তা দেখিয়ে প্রকল্পের নামে ব্যাপক অর্থ লুটপাট, আত্মসাৎ করছে। চক্রটি এ পর্যন্ত কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কীভাবে লুটপাট করা হয়েছে, তা এর আগে বাপেক্সে ও পেট্রোবাংলার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণ হয়েছে। থ্রিডি সাইসমিক প্রকল্পে প্রায় ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা কোনো কাজেই আসেনি। প্রকল্পের ব্যয়ের ৪৫ শতাংশ বৈদেশিক অর্থ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সার্ভে, সাইসমিক লাইন ডিজাইন, উপাত্ত সংগ্রহ ও উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি-সফটওয়্যার কেনার জন্য আন্তর্জার্তিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়; কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে একাধিক দরপত্র বিক্রি হলেও শুধু আর্নিব এন্টারপ্রাইজের লোকাল এজেন্টশিপের অন্তর্ভুক্ত ১টি করে দরপত্র জমা পড়ে। একটি করে দরপত্র জমা পরলে পুনঃদরপত্র আহ্বান বাঞ্ছনীয় থাকলেও তা না করে একটি বিশেষ কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়।
অ্যাপ্রাইজাল অব গ্যাস ফিল্ডস (থ্রিডি সাইসমিক) প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতির মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকার মালামালও লোপাট করা হয়। ফলে তদন্ত কমিটির কাছে কেনা মালামাল বুঝিয়ে দিতে পারেননি প্রকল্প পিডি। এসব দুর্নীতির অভিযোগ যিনি তোলেন, তার বিরুদ্ধে হয়রানি মামলা দেওয়া হয়, নয়তো তাকে বাপেক্সে থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বদলি নিতে বাধ্য করা হয়।