ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় একটি নতুন রাজনৈতিক দলের গড়ে ওঠা নিয়ে সবখানে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ করা যাচ্ছে। দুই প্রধান দলের বাইরে সত্যিকার অর্থে বড় রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের চেষ্টা এবারই প্রথম—সম্প্রতি এক সেমিনারে প্রখ্যাত চিন্তক রেহমান সোবহান এমন মন্তব্য করেছেন। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনা অত্যন্ত ইতিবাচক। কারণ, দলটির নেতৃত্বে থাকবেন গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে অর্গানিকভাবে উঠে আসা তরুণ নেতৃত্ব।
ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিসর উন্মুক্ত হয়েছে। রাজনীতি ও নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। এসবই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৌন্দর্য। নতুন রাজনৈতিক দল ঘিরেও পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনায় ‘কিংস পার্টি’ কথাটা উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতায় ছাত্ররা একটি কিংস পার্টি গঠন করতে যাচ্ছে। বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।
প্রথমেই বলতে হয়, ধারণাগত ও বাস্তব পরিস্থিতিগত কারণে এ অভিযোগ অমূলক। সাধারণত কোনো সামরিক স্বৈরাচার সরাসরি কিংবা তাদের সমর্থনে অরাজনৈতিক কোনো গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর সেই ক্ষমতা সুসংহত ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে জনবিচ্ছিন্ন এলিট এবং দলছুট রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে দল গঠনের উদ্যোগ নিলে তাকে কিংস পার্টি বলা হয়।
মূলত অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়াই থাকে এ ধরনের কৃত্রিম ও আরোপিত দল গঠনের লক্ষ্য। ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখে একটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ওই দলকে জেতানো হয়। তারপর ওই দল সংসদে গিয়ে কিংবা অর্ডিন্যান্স জারি করে অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতার বৈধতা প্রদান করে।
বলা বাহুল্য, উল্লিখিত প্রকল্পের সঙ্গে ৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক রয়েছে। সেদিন বাংলাদেশে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি। নজিরবিহীন এক গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে। কাজেই কিংস পার্টি গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা সমাজে হাজির নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্বের রয়েছে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তি। তাঁরা সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন এবং জনগণের কাছে যাচ্ছেন। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক শূন্যতা দূর করতে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির যে প্রয়োজন, তা জনগণ তাঁদের মতামতে জানিয়েছেন।
আরও দুটি বিষয় খেয়াল করা দরকার। প্রথমত, গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ শাসনামল ছিল মূলত এক-এগারোর বিরাজনীতিকরণ প্রকল্পেরই ধারাবাহিকতা।
এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল হলেও বিরাজনৈতিক প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছিল। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্মৃতিকথা কোয়ালিশন ইয়ার্স–এ তিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার কথা অকপটে উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন সুশীল-সামরিক সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার ক্ষেত্রে প্রণব মুখার্জি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা এখনো অটুট রয়েছে। ব্যবস্থা পরিবর্তনে আগ্রহী ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার নানা স্তরের কাঠামোর কার্যকর সংযোগ প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় ছাত্র-তরুণদের আসন্ন রাজনৈতিক দলকে ‘কিংস পার্টি’র তকমা দেওয়া অমূলক, অনৈতিহাসিক ও অন্যায্য।
পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, আক্ষরিক অর্থেই গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরকে চরমভাবে সংকুচিত করেছে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের হয়রানিমূলক মামলা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তারা; অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এক-এগারোর বিরাজনীতিকরণের প্রকল্পই বাস্তবায়ন করেছে। এক-এগারো যদি হয়ে থাকে মাইনাস টুর ষড়যন্ত্র; আওয়ামী শাসনামল ছিল রাজনীতি মাইনাসের বাস্তবায়ন। দেশ থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মাইনাস করে দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিশালী ও দমনমূলক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা।
ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করা দরকার। আওয়ামী লীগের বিরাজনৈতিক ও মাফিয়া শাসনের বিরুদ্ধে জুলাই মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বে অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক-এগারো ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত ১৭ বছরের বিরাজনৈতিক শাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাজনীতির উত্থান।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতি ফিরে এসেছে। বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল বিগত ১৫ বছর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেনি, তারা এই অভ্যুত্থানের পর বিপুল শক্তি নিয়ে রাজনীতিতে ফিরতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল আবির্ভাবের অপেক্ষায় আছে। আরও খেয়াল করা দরকার, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি এই গণ-অভ্যুত্থানে ‘জনগণ’ শুধু রাজনৈতিকবর্গ আকারে নয়, বাস্তব শক্তি হিসেবে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। এমন পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই এক-এগারো পরবর্তী মাইনাস টুর সঙ্গে তুলনা করা চলে না।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গড়ন ও মেজাজ আমলে নেওয়া দরকার। গণ-অভ্যুত্থানই বর্তমান সরকারের ম্যান্ডেট। রাষ্ট্র সংস্কার করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন এবং এ জন্য সংবিধান প্রণয়ন করা এই সরকারের প্রধান কর্তব্য। এটা স্বীকার করতে হবে যে এই সরকার বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়া। কিংস পার্টি গঠনের জন্য একই লক্ষ্য ও অভিমুখে ধাবিত যে ধরনের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠীর প্রয়োজন, এই সরকার তা নয়, এর গঠনও তেমন নয়। ব্যবস্থার মৌলিক ও গভীর পরিবর্তন চায়, এমন শক্তি যেমন সরকারে আছে, তেমনি পুরোনো ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে কিছু উপরি সংস্কার করে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে চায়, তেমন শক্তিও আছে। আবার কোনো ধরনের পরিবর্তনই চায় না, স্রেফ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল করতে চায়, এমন শক্তি সমাবেশও বর্তমান সরকারে রয়েছে।
অর্থাৎ, কিংস পার্টি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে চালিত শক্তি বর্তমান সরকারে নেই।
সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো সরকার গঠিত হলে একটি সরকারি দল থাকে, একটি বিরোধী দল থাকে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের (তা সে সরকার যতই অপরিণত হোক না কেন) কোনো ‘সরকারি দল’ নেই। কিন্তু যারা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে পুরোনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষমতাসীন পক্ষ। অন্যদিকে যারা বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান ও বন্দোবস্তের দাবিতে রাজনীতিতে আবির্ভূত হচ্ছে, তারা বিদ্যমান ক্ষমতার বিরোধী পক্ষ। এ বিচারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে অনাগত রাজনৈতিক দল অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বিরোধী দল।
মাঠপর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রশক্তির কোনো কার্যকর যোগাযোগ নেই। স্থানীয় প্রশাসন মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করেই কাজ করছে। কারণ, তারা ধরে নিয়েছে নির্বাচনে সম্ভাব্য যে দল ক্ষমতায় আসবে, তার সঙ্গে সমঝোতা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিভিন্ন বড় রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক ও আঁতাতের খবর প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা এখনো অটুট রয়েছে। ব্যবস্থা পরিবর্তনে আগ্রহী ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার নানা স্তরের কাঠামোর কার্যকর সংযোগ প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় ছাত্র-তরুণদের আসন্ন রাজনৈতিক দলকে ‘কিংস পার্টি’র তকমা দেওয়া অমূলক, অনৈতিহাসিক ও অন্যায্য।
দল গঠনের আগেই ছাত্র-তরুণ শক্তির রাজনৈতিক উদ্যোগকে কিংস পার্টি তকমা দেওয়া একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগকে কলঙ্কিতকরণের নামান্তর মাত্র। তবে এসব প্রচারণায় বিচলিত না হয়ে নতুন দলের উদ্যোক্তা ও নেতৃত্বের উচিত হবে জনগণের কাছে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া।
● সারোয়ার তুষার লেখক ও যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি