অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠিত এই সরকারের ছয় মাসের অর্জন ও ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য একটি প্রশ্নহীন সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সব হত্যাকা-ের বিচার এবং নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা করা। গণ-অভ্যুত্থানের দাবি অনুযায়ী, এই সরকারের বড় দায়িত্ব সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরানো এবং অপশাসনের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্র সংস্কার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এক্ষেত্রে ছয় মাসে সরকারের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো, যদিও পরিস্থিতিগত কারণে সাফল্য-ব্যর্থতা ওঠানামার মধ্যেই রয়েছে। সরকারের অর্জন অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার মতো ব্যর্থতার কারণে। কারও কারও মতে, লক্ষ্য অর্জনে সরকার ইতোমধ্যে সুযোগ হাতছাড়া করেছে। তবে অংশীজনদের সহায়তা পেলে এখনও ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই দ্রুত নির্বাচন দিয়ে তারা বিদায় নিতে বলেছেন। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুটি সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করেছিলেন। তবে অতিসম্প্রতি তিনি নির্বাচনের জন্য চলতি বছরের শেষ সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই রাজনৈতিক মহলের ধারণা, চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে যেতে পারে সরকার। একটি জাপানি গণমাধ্যমে দেওয়া এই ঘোষণাকে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতিফলন বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাসের সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা ওঠানামার মধ্যেই আছে। তবে মনে রাখতে হবে, এই সরকারকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তারা চেষ্টা করেছে। তবে ভালো করেছে বলা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রেই ভালো করতে পারে নাই। এ বিশ্লেষক শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। এরা ব্যর্থ হলে আমরা বড় বিপদে পড়ে যাব।
সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ বলে মনে করছেন জানতে চাইলে বদিউল আলম বলেন, ব্যর্থতার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ করেছে বিগত সরকার, সেটা ভাঙতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেনি। বর্তমানে বিশৃঙ্খল একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সেটা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। চারদিকে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারকে এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের এই ব্যর্থতাগুলো তাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবুও মানুষ চায় এই সরকার ভালো কিছু করবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসের কর্মকা- নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এরই মধ্যে পাঁচটি কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। অন্যান্য কমিশনও এই মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ দেবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে সংস্কার প্রস্তাব কেমন হলো সেটা বোঝা যাবে যখন বাস্তবায়ন হবে।
সরকার সুযোগ হাতছাড়া করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার পতনের পর যে জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল, তখন যদি সরকার সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কর্মকৌশল তুলে ধরত; তা হলে এখন যে বিতর্কগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো হতো না। এখন সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিপরীত দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখানে সরকার সুযোগটা হাতছাড়া করেছে। তার পরও সকল অংশীজন যদি সহযোগিতা করে, তা হলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।
ছয় মাসে সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে যখন আলোচনা, তখন নির্বাচনের একটা ধারণা নতুন করে সামনে এনেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একটি বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় হতে পারে চলতি বছরের শেষ দিক।
এদিকে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে। তার এই কথায় স্পষ্ট হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারছে না।