ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে লাতিন আমেরিকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় আসতে চলেছে। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এ নিয়ে এক কঠিন ও ঝোড়ো ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিয়েছেন।
বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ট্রাম্পের পানামা খাল দখলের হুমকি।
লাতিন আমেরিকার তুলনায় আমেরিকার ক্ষমতা অনেক বেশি। বারবার সে আক্রমণাত্মক হয়ে হুমকি দিয়েছে। কিন্তু লাতিন আমেরিকা এ ধরনের হুমকি মোকাবিলা করেছে।
১৯৮০-এর দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান মধ্য আমেরিকায় তাঁর হালকা মাপের সংঘাতের নীতি চালু করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮৩ সালের মধ্যে কলম্বিয়া, মেক্সিকো, পানামা ও ভেনেজুয়েলার সরকারসমূহ গঠন করে কন্টাডোরা গ্রুপ। মধ্য আমেরিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই গ্রুপ।
১৯৯৬ সালে কিউবায় বিদেশি বিনিয়োগ রুখতে মার্কিন কংগ্রেস হেলমস-বার্টন আইন পাস করে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ রিও গ্রুপ গঠন করে এই আইন পরীক্ষা করার জন্য আমেরিকান রাষ্ট্রগুলোর সংস্থার কাছে অনুরোধ করে। কমিটি উল্লেখ করে যে হেলমস-বার্টন আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২০০৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯১ সালের একটি প্রস্তাব ব্যবহার করে ইরাক আক্রমণের জন্য দ্বিতীয় অভিযান চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু চিলি ও মেক্সিকো ভিন্নমতাবলম্বী দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে নীতিগত অবস্থান বজায় রাখে।
শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে পরাজয় এড়িয়ে আক্রমণে ইচ্ছুকদের জোট গঠন করে ইরাকে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এই দুই দেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নিতে পারেনি; বরং সেই বছর মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিনিয়োগ প্রণোদনা চুক্তি স্বাক্ষর করে। আর মার্কিন কংগ্রেস অনুমোদন করে চিলি-যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে পেন্টাগন ১৯৫০ সালে নিষ্ক্রিয় করা চতুর্থ নৌবহর আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০০৮ সালে ব্রাজিলের উদ্যোগে দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিরক্ষা কাউন্সিল গঠন করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্প্রদায় গড়া এবং দক্ষিণ আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনার বিস্তার রোধ করা।
এই উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায় যে কঠিন পরিস্থিতি এবং অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং সব বিষয় নিয়ে লাতিন আমেরিকা কীভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। প্রয়োজনমতো বিভিন্ন ফোরাম গড়ে সেগুলোর কার্যকর ব্যবহারও তারা করেছে।
বর্তমানে মনে হচ্ছে, নতুন ট্রাম্প প্রশাসন লাতিন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুল্ক, অভিবাসন, মাদক পাচার এবং শক্তি প্রয়োগের মতো বিষয়গুলোর ওপর মনোযোগ দেবে। শুল্কের প্রশ্নে লাতিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আচরণ ঠেকাতে ইউরোপ, চীন ও ভারতের সঙ্গে মিলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যৌথ উদ্যোগ নিতে পারে।
অভিবাসন ঠেকানো নিয়ে তারা আন্তর্জাতিক আইনের নিয়মাবলি, আমেরিকান মানবাধিকার কমিশনের সিদ্ধান্তের রেকর্ড এবং আন্ত আমেরিকান মানবাধিকার আদালতের গণবহিষ্কারের মতো প্রস্তাবনাগুলো সামনে নিয়ে আসবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ট্রাম্পের ‘গণহারে ফেরত পাঠানো’ নীতির অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে আবেদন করবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে লাতিন আমেরিকায় ছোট অস্ত্রের বাণিজ্যের ফলে প্রাণহানির মাত্রা বাড়তে পারে। লাতিন আমেরিকা সেটা ঠেকানোর জন্য আগে থেকেই চেষ্টা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের আন্তসীমান্ত সংঘটিত অপরাধবিরোধী কনভেনশনের ২৫তম বার্ষিকীতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো একটি শীর্ষ সম্মেলন করবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯৯৭ সালের আন্ত আমেরিকান অস্ত্র কনভেনশন অনুমোদনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হবে।
অবশেষে আসে শক্তি ব্যবহারের প্রসঙ্গ। লাতিন আমেরিকায় দীর্ঘ সময় ধরে আন্তরাষ্ট্রীয় শান্তি বজায় রয়েছে। এই অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। একে ঝুঁকির মুখে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। অথচ মার্কিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহিংসতা উসকানি দেওয়া বিভিন্ন মন্তব্য আন্তর্জাতিক সংঘাতকে বাড়িয়ে দেয়। এ বিষয়ে লাতিন আমেরিকার সতর্ক থাকার ব্যাপার আছে।
শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ, সাহায্য ও বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করেছিল। এর বিনিময়ে লাতিন আমেরিকার কাছ থেকে দাবি করেছিল সোভিয়েতবিরোধী অবস্থান। আজ চীনকে মোকাবিলা করতে তারা খুব অল্প বিনিয়োগ করে। কিন্তু দাবি করে অনেক বেশি। লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ আজকে চীনের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যথেষ্ট সতর্কতা এবং বাস্তব বুদ্ধির সঙ্গে পরিচালনা করছে। চীন এই অঞ্চলের শীর্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অন্যতম। এ অঞ্চলের যে দেশগুলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্য, আর্থিক ও সহায়তামূলক সম্পর্ক ছিন্ন করতে অনিচ্ছুক, তারা ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনের হুমকি এবং নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হচ্ছে। এর সর্বশেষটি পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার সম্পর্কের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাগুলো ভবিষ্যতের কর্মকৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে। কিছু দেশ একসঙ্গে কাজ করতে চাইবে। কেউ হয়তো তাতে রাজি হবে না। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি এমন নেতিবাচক এজেন্ডা নিয়ে হুমকি দিতে থাকেন, তাহলে সম্ভবত লাতিন আমেরিকার কাছ থেকে সমর্পণ কম, প্রতিরোধ আসবে বেশি।
● হুয়ান গ্যাব্রিয়েল তাকাতলিয়ান আর্জেন্টিনার ইউনিভার্সিদাদ তোরকুয়াতো দি তেল্লায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন