পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার কমে গেছে। আর রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া যাচ্ছে বিনা বাধায়। এখন ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া যাচ্ছে সোয়া ৩ ঘণ্টায়। যাতায়াত সহজ হয়েছে দক্ষিণের ২১ জেলাতেই। তবে দুটি পদক্ষেপ নিতে পারলে যাতায়াত আরও সহজ হতো বা হবে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ঢাকা শহর এড়িয়ে গাড়ির চাপ সামলানোর ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, এক্সপ্রেসওয়ে পাড়ি দেওয়ার পর ভাঙ্গা থেকে বাকি অংশও দুই লেনের পরিবর্তে চার লেন করা।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, সরকারের পরিবহন পরিকল্পনায় পদ্মা সেতুর কথা চিন্তা করেই রিং রোড ও বৃত্তাকার পথ রাখা হয়েছিল। এটি করতে পারলে রাজধানীর ভেতরে গাড়ির চাপ পড়বে না। শহরের বাইরে দিয়ে এক প্রান্তের গাড়ি অন্য প্রান্তে যেতে পারবে।
ড. হাদিউজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দ্রুত গাড়ি চলে আসতে পারছে। যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি এখন কীভাবে ঢাকা অতিক্রম করবে, সেটি বড় সমস্যা। সায়েদাবাদ বা যাত্রাবাড়ী দিয়ে বাস যাতায়াত করতে চাইছে। পণ্য পরিবহনের অবস্থা কী হবে, তাও ভেবে দেখা দরকার। একই অবস্থা ভাঙ্গার পরের অংশেও। ২১ জেলার কানেকটিং রোডগুলো দুই লেনের। অথচ ওই এলাকায় শিল্পকারখানা, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। সে কারণে বাড়বে গাড়ির সংখ্যাও। একে বলে ‘ইনডিউস ট্রাফিক’। পদ্মা সেতুর ফলে দূরত্ব কমে গেছে। এখন সময় কমাতে সড়কের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দুই লনের সড়ক দ্রুত চার লেন করতে হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়েছে ১৯৯৮ সালে। আর এখন নির্মাণ হচ্ছে চার লেনের সড়ক। এতে করে উত্তরাঞ্চলের মানুষ ২৫ বছরেও বঙ্গবন্ধু সেতুর পুরোপুরি সুফল পাননি। পদ্মা সেতুর ফলে ২১ জেলার শিল্পায়ন, কৃষি বাণিজ্যের উন্নতির সুফল মিলতে এসব সড়ক বিস্তৃত করতে হবে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে সরকার ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক (এন-৮) ছয় লেনে উন্নীত করে। মাওয়া হয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে ঢাকা থেকে বের হওয়ার মূল পথে বুড়িগঙ্গার ওপর রয়েছে দুটি সেতু। একটি বাবুবাজারে, অন্যটি পোস্তগোলায়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ঢাকার যানজট ঠেলে এই দুটি সেতুতে উঠতে পারলেই অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। কারণ ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটারের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত চার লেনের মহাসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। কিন্তু সেই পর্যন্ত যাওয়ার পথ মসৃণ নয়। এসব গাড়িকে ঢাকার ভেতর দিয়ে যেতে হলে রাজধানীর অসহনীয় যানজট আরও বাড়তে পারে। তা ছাড়া দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবাহী গাড়ি দিনের বেলায় শহরের ভেতর প্রবেশের বৈধতা নেই। অথচ ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা এতদিনে বাস্তবায়ন হলে এ বিড়ম্বনায় পড়ার শঙ্কা ছিল না।
বর্তমান অবস্থায় গাবতলীর গাড়ি পদ্মা সেতু ব্যবহার করে দক্ষিণবঙ্গে যেতে পারছে না। একই অবস্থা ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহের মহাসড়কের দক্ষিণবঙ্গমুখী যানবাহনের বেলায়। রাজধানীতে প্রবেশ না করে দেশের অন্য মহাসড়কের যানবাহনের এক্সপ্রেসওয়েতে যাওয়ার পথ নেই।
পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহের গাড়িকে যানজটে পূর্ণ রাজধানী পেরিয়ে পোস্তগোলা বা বাবুবাজার সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়ায় যেতে হবে। অথচ সার্কুলার রুট হলে অনায়াসে আব্দুল্লাহপুর দিয়ে সার্কুলার রুট ধরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে যাওয়া যেত। ২০০৪ সালেই বলা হয়েছিল, ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক পথ নির্মাণের। তাই সায়েদাবাদ থেকে মাত্র ১২ রুটসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার মিলে ১৫ রুটের গাড়ি ঢাকার পোস্তগোলা দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে পারবে। গাবতলী, মহাখালী বা অন্য গন্তব্যের গাড়ি পদ্মা সেতুর সুফল পাচ্ছে না।
ফেরি মানেই ঘাটে ভোগান্তি, ধীরগতির নদী পারাপার, ঘন কুয়াশা, ঝড় ও দুর্যোগে যাত্রা বাতিল এবং বেশি স্রোত অথবা নদীর নাব্যতা সংকটে ফেরি অচল। এখন সেই দুর্ভোগ নেই। জাইকার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৬২ হাজার ৫০০ যাত্রী প্রতিদিন ঢাকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি নদী পার হয়। যানবাহনের সংখ্যার দিক থেকে বলা যায়, প্রতিদিন ২ হাজার ৯০৯টি যানবাহন পদ্মা পাড়ি দেয়, যার মধ্যে ১ হাজার ২৯৫টি ট্রাক, ৭০০টি হালকা যান এবং ৯১৪টি বাস। ধারণা করা হয়েছিল, পদ্মা সেতুর ফলে এসব গাড়ির দৈনিক পরিচালন ব্যয় কমে আসবে। এর ফলে পরিবহনের বছরে মোট সাশ্রয় হবে ৪৩৮ কোটি টাকা। আর ফেরির অপেক্ষার সময় যোগ করলে মোট সাশ্রয় হওয়া সময়ের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এখন কোন রুট দিয়ে গাবতলী অঞ্চলের গাড়ি চলবে, তা নির্ধারণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। গতকাল পর্যন্ত খবর গাবতলীর গাড়ি সায়েদাবাদ দিয়ে যাওয়ার রুট পারমিট চেয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় দুইশ বাস অনুমোদন পেয়েছে। নতুন বাসও নামছে পদ্মা সেতুর রুটে। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচল করা গাবতলী এলাকা থেকে ছাড়া সব গাড়ির সংকুলান হবে না সায়েদাবাদ টার্মিনালে।
পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাতায়াতের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ভাঙ্গা। সেখানে চারটি মহাসড়ক গিয়ে মিশেছে। এসব মহাসড়কের যানবাহন চলার পথ নির্বিঘ্নে করতে ভাঙ্গায় নির্মাণ করা হয়েছে বহুমুখী উড়ালপথ, যা প্রকৌশলীদের ভাষায় ‘ক্লোভারলিফ ইন্টারচেঞ্জ’ নামে পরিচিত। এটি চারটি মূল মহাসড়কে উড়ালপথে যুক্ত করেছে। ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জের ঢাকামুখী মহাসড়কটি পদ্মা সেতুতে মিশেছে। অন্য তিনটির মধ্যে একটি ভাঙ্গা-মাদারীপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা; একটি ভাঙ্গা-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট-খুলনা-সাতক্ষীরা এবং আরেকটি গেছে ভাঙ্গা-ফরিদপুর-রাজবাড়ী-গোয়ালন্দের দিকে। ঢাকাসহ সারাদেশের যানবাহন পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গায় গিয়ে বিভিন্ন দিকে যাবে। মাদারীপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী হয়ে একটি মহাসড়ক কুয়াকাটায় গিয়ে শেষ হয়েছে। গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনামুখী মহাসড়কটির বেশ কিছু বিকল্প পথ আছে। একটি পথ গোপালগঞ্জের ভেতর দিয়ে নড়াইল হয়ে যশোরে সংযোগ স্থাপন করবে। যশোর সংযুক্ত হওয়া মানে হলো সেখান থেকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গেও সংযুক্তি। তবে এর জন্য গোপালগঞ্জ ও নড়াইলের মধ্যে নির্মাণাধীন কালনা সেতু চালু হতে হবে। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষের পথে।
গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাট, মোংলা বন্দর এবং পিরোজপুরের সহজ যোগাযোগ রয়েছে। ভাঙ্গা থেকে একটি মহাসড়ক গোয়ালন্দের দিকে গেছে। সেটি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে খুলনাগামী মহাসড়কে সংযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এই পদ্মা সেতু সারাদেশের সঙ্গেই সড়কপথে এক যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছে। কিন্তু দুই লেনের কারণে এসব সড়ক গাড়ির চাপ সামলানোর জন্য প্রস্তুত নয়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, ঢাকা ঘিরে বিকল্প সড়কগুলো পাঁচ বছরের মধ্যে চালুর সম্ভাবনা নেই। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ অন্যান্য জেলায় যাওয়ার সব পথই দুই লেনের। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দরের দূরত্ব প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার। এই সড়ক বরিশাল বিভাগের প্রায় সব জেলাকেই যুক্ত করবে। ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ২০১৮ সালের শেষের দিকে একনেকে একটি প্রকল্প পাস হয়। সড়কের পথ পরিবর্তনের কারণে নির্মাণকাজ শুরু হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশের মহাসড়ক নেটওয়ার্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ সেতু আমাদের জন্য যেমন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তেমনি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণের জন্য বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করেছে।’
জানা গেছে, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা- এই তিন নদী বাংলাদেশের ভূখ-কে মূল তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। ঢাকা ঘিরে মধ্যাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ নিয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে। মেঘনা সেতু, মেঘনা-গোমতী সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু (ভৈরব) নির্মাণের ফলে মধ্য, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সম্ভব হয়। আর পদ্মার কারণে গোটা দেশ এসেছে একই সড়ক নেটওয়ার্কে। এখন পদ্মা সেতুর কার্যকর সুফল পেতে ঢাকা ঘিরে নির্মাণ করার কথা বৃত্তাকার সড়ক। আবার সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণও আলোচনায় আছে। উত্তরাঞ্চল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট রুটের যানবাহন যাতে ঢাকা এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে যেতে পারে, সে জন্য এই বিকল্প উড়ালসড়ক নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে সরকার। ২০১৭ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয়।
পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২৪ সালে এই উড়ালসড়ক চালু হওয়ার কথা। এতে জাপান অর্থায়ন করতে চেয়েছে। তবে এখনো ঋণচুক্তি হয়নি। প্রস্তাবিত উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
সাভারের হেমায়েতপুর থেকে এটি কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ সদরে যাওয়ার কথা। নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দরকে যুক্ত করতে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এই সেতু চালু হলে উড়ালসড়কটি নারায়ণগঞ্জের মদনের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে যুক্ত করবে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না হলেও বাইপাসের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যাবে। ঢাকা-পাটুরিয়া হয়ে খুলনা মহাসড়ক এবং নবীনগর হয়ে ঢাকা-উত্তরবঙ্গের সব মহাসড়ক যুক্ত হবে হেমায়েতপুরে।