বহু বিকর্তের জন্ম দিলেও বাতিল হচ্ছে না সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের শরীফ থেকে শরীফার গল্প। তবে এক দুটি শব্দ সংশোধন করার বিষয়ে চিন্তা করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ট্রান্সজেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়ে লেখা শরীফার এই গল্পটি ঘিরে ইতোমধ্যে দেশে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুসলিম গবেষকদের মধ্যে এই গল্পটির নেতিবাচক দিক নিয়ে সমালাচনা অব্যাহত রয়েছে। গল্পটি নিয়ে সমালোচনা করায় এরই মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যাবিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের চাকরিও চলে গেছে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই বিতর্কিত গল্পটি নিয়ে রীতিমতো ট্রল করা হচ্ছে। মেয়ে থেকে ছেলে হওয়ার কাল্পনিক যে গল্প কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে দেয়া হচ্ছে তা আমাদের আগামীর প্রজন্মের জন্য শুভকর নয় বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা অবিলম্বে এই ধরনের গল্প পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন।
অপরদিকে সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা আবুল মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পাঠ্যবইয়ে সব সম্প্রদায়ের মানুষের কথা যেন থাকে সে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। কারণ আমরা চাই কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি যেন শিশুদের মনের মধ্যে কোনো ধরনের হেয়বোধ বা তুচ্ছ ধারণা না থাকে। সমাজস্বীকৃত লিঙ্গের বর্গবহির্ভূতদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গ বলে থাকি। ব্যাপক অর্থে হিজড়া বলে পরিচিত। ট্রান্সজেন্ডার, থার্ড জেন্ডার- এসব বিষয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে শিক্ষার্থীরা যতটুকু বুঝতে পারবে, ততটুকু জানানোর কাজটাই আমরা করেছি।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পাঠ্যবইয়ের এই অংশ নিয়ে তার কাছেও একটি পক্ষ গিয়েছিল। তারা দাবি করেছেন, এখানে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টির বিষয়টি তারা আমাদের নজরে এনেছিলেন। তবে আমরা যখন আলোচনা করেছি তখন দেখেছি শব্দটা ট্রান্সজেন্ডার নয়, শব্দটা থার্ড জেন্ডার অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গ। এটা আইনত স্বীকৃত যে, তারা তৃতীয় লিঙ্গ; সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত তারা। তারা আমাদের দেশের নাগরিক। তাদের নাগরিক অধিকার রয়েছে।
নতুন পাঠ্যক্রমে সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ট্রানজেন্ডার বিষয় অন্তর্ভুক্তি নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল সমালোচনার মধ্যে এনসিটিবি জানিয়েছে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করছে তারা। এ নিয়ে শিগগিরই বিস্তারিতভাবে পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রস্তুত করে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমে পাঠাবে এনসিটিবি।
সূত্র জানায়, নতুন বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সময় এনসিটিবির পক্ষ থেকে সব শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে কোনো পরামর্শ থাকলে তা অবহিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। সেই আহ্বানে ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন অনেকেই। এনসিটিবি বলছে, সবার মূল্যবান মতামত আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তক যৌক্তিকভাবে মূল্যায়ন করে সংশোধনীগুলো অতি দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমে পাঠানো হবে।
ইতোমধ্যে ‘শরীফার গল্প’ গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এনসিটিবিকে সহায়তা করার জন্য পাঁচ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদকে এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ।
এনসিটিবির সর্বশেষ অবস্থান হচ্ছে- বিতর্ক থাকলেও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে শরীফার গল্প বাতিল হচ্ছে না। তবে প্রয়োজনে শব্দগত কিছু সংশোধন হতে পারে। গতকাল রোববার বিকেলে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা শরীফার গল্পে কোনো ধরনের বিতর্ক তো দেখছি না। এখানে আপত্তি থাকারও কোনো বিষয় নেই। এই গল্পে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো তো পারমিটেড বিষয়। ট্রানজেন্ডার তো মুসিলম দেশ মিসরে আছে, মালয়েশিয়াতেও আছে। এসব দেশে তো আইন করেই বিষয়গুলোর বৈধতা দেয়া হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আমরা যে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করেছি তাদের মতামতের ভিত্তিতে হয়তো শব্দগত কিছু সংশোধন করা হতে পারে। শরীফার গল্প বাতিল বা আমূল পরিবর্তনের কোনো সুযোগ বা কারণ আছে বলে আমরা মনে করছি না।