মুরগীর রান আমি কখনো খেতে পারিনা ভয়ে , আতংকে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি । ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠে এই ! এইটা তোর জন্য নয় ! আমি ভিতর থেকে চুপসে যাই । আমি আর রানের দিকে ভুল করেও হাত বাড়াইনা ।একসময় রান খাওয়ার জন্য যে হা-পিত্যেশ ছিল তা কবে কখন মরে গেছে তা নিজেও জানিনা ।শুধু জানি এটা আমার নয় অন্য কারো । ভিতর থেকে জেনে গেছি ।মগজে পুক্ত হয়ে বসে গেছে কখনো ভুল হয়না ।
রানটা কেন আমার নয় তবে বলি ।
আমার নিম্নমধ্যবিত্ত বাবার বাড়িতে তখন মাসে ২/১ বার মুরগীর মাংস রান্না করা হলে একটা বাবার জন্য আরেকটা ছোটভাইয়ের জন্য । এভাবেই রানের ভাগবাটোয়ারায় অভ্যস্ত ছিলাম । এ নিয়ে কোন অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না । মাকে কখনো ও বলিও নি মা আজ আমাকে রান দেও ।ধর্মীয় বা সামাজিক বিধি নিষেধের মত নিরবে মেনে নিয়েছিলাম । কেউ আমাকে বলেনি মেয়েদের রান খেতে নেই । আমার মা ও খাননি আমার ছোটবোন ও না ।
এইটা অলিখিত একটা নির্দেশ । অমান্য করা যাবে না করতেও ইচ্ছা করতনা । রানের উপর অধিকার শুধু পুরুষের একচেটিয়া এই মন্ত্রেই আমি দিক্ষিত হয়েই উঠেছিলাম ।এই মন্ত্র কেউ আমাকে কানে কানে দেয়নি আমি নিজেই শিখে নিয়েছিলাম ।
সেই নিয়ম মেনেই বিয়ের পর আমার অসম্ভব ভালোমানুষ শ্বশুর মহাশয় অথবা আমার স্কুলের হেডমাষ্টার মার্কা স্বামী অথবা আমার আহ্লাদী দেবরের জন্য বরাদ্দ ছিল । কেউ বেড়াতে আসলে রান দিয়ে তাকে সম্মান জানানো আমাদের রেওয়াজ তবে সে যদি হয় পুরুষ ।মহিলা কক্ষনো নয় ।আমার হাতেই রানটা উঠবে না তাকে দেই । কারণ আমার মগজ জানান দেয় রান নারীদের জন্য নয় ।আমি ওকে রান ছাড়া আর সবই অনায়াসে দিয়ে দিতে পারি নির্বিবাদে ।
তারপর আসল আমার সন্তান ।সে বড় হতে লাগল । রান চলে গেল তার ভাগে সে কটমটিয়ে দুইটি রানই একসাথে খেয়ে ফেলে ।
একটা এখন আর রান্না হয় না দুটো করে রান্না হয় ।আবার আগের হিসেব শ্বশুর, দেবর স্বামী , ছেলে । তারপর আমার মেয়ে বড় হল খাওয়া শিখেছে ।আমি মা ,সন্তানের সাথে তো আর দু চোখ বানা করতে পারিনা । এখানে এসে প্রথা ভাংলাম । এখন দু’টো রান আমার ছেলের আর দু’টো আমার মেয়ের ,আমাদের সাথে থাকত আমার ছোট দেবর যার নাম দীপু ।সে বড় হয়েও একটু না ,বেশীই আহ্লাদী ছিল । আমার সাথে তার যত আব্দার। জীবনে অনেক টাকা হাওলাদ নিয়েছে ফেরত দেয় নাই ।তারপর আমি ঠকতে ঠকতে সিস্টেম করলাম সাদা কাগজে সাইন দিয়ে টাকা নিবে আবার আমি টাকা পেলে বুঝিয়া পাইছি এই মর্মে সাইন দিয়া নিব ।এইসব কঠিন নিয়ম কানুন করেও কোন কাজ হয় নাই ।
একতরফা সাইনের লিস্ট একমাইল লম্বা আর বুঝিয়া পাইলাম কোন সাক্ষরই নাই ।
সিলেটে এক প্রবাদ আছে “কোন বুদ্ধি না খাটিল ঘর পুড়ার কাছে” আমারও হল তাই ।কোন বুদ্ধিই কাজে লাগছেনা । সেই দেবর একদিন মুখ ঝুলিয়ে বলল আচ্ছা বৌদি তোমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত তুমি কি তাকে রান দিতানা ? তখন সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরীর অপেক্ষায় আছে । আমি দেখলাম কথাটার যুক্তি আছে ।ও হাতে পায়ে বড় হলেও মনের দিকথেকে শিশুই রয়ে গেছে । আমি আমার মেয়ের ভাগেরটা কমিয়ে একটা রান ওর জন্য বরাদ্দ করলাম ।
একদিন দীপু ৪ টা মুরগী কিনে এনে বলল আজ সবগুলি রান্না করবা কোন রাখারাখি নাই । আর মাটিতে বসে খাব পুরোকড়াই নিয়ে ছোটবেলার মত করে । আমি রান্না করলাম কিন্তু আমার রান খাওয়া হলনা ।কোন অদৃশ্য শক্তি যেন আমার হাত চেপে ধরল । আমি আমার ছেলেমেয়ের জন্য তুলে রাখলাম ওরা পরে খাবে ।বিয়ে বাড়ি গেলেও আমি রান এভয়েড করি ।ওখানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই । কিন্তু ওই যে আমি ভিতর থেকে নিষেধাজ্ঞায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি সেই নিষেধাজ্ঞা আর ভাংতে পারিনা ।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল আমার ছেলের বউ খেতে বসে মামণি আমাকে রানটা দেও না ! আমি তো হাসতে হাসতে শেষ । সে ও আমার মেয়ে রানের সম্পুর্ণ অধিকার তার আছে ! মায়াকে ডেকে বললাম ওকে সবসময় রান দিবি অতনু কে থাকলে দিবি না থাকলে নাই ।
প্রথা ভাংগার প্রথা ।
আসলে মানুষ অভ্যাসের দাস ।
শুভ্রা নীলাঞ্জনা
কবি , লেখিকা – কণ্ঠশিল্পী – আবৃত্তিকার ।
তারিখ : ১৭-০৬-২০২২