এই ভাদ্রের কড়া রোদেও তারা বর্ষার থইথই পানির স্বপ্নে আজ বিভোর। কিন্তু ঘটনা অন্যখানে! হাওর ঘেরা প্রান্তিক জেলেদের দুর্বিষহ দিন যেন ফিরে ফিরে আসছে। জাল ফেলতে পারছে না তারা হাওর-বিলে। কারণ, যেখানে প্রভাবশালী সুবিধাবাদী সংঘবদ্ধচক্রের রক্তচক্ষুময় আপত্তি!
জাল ফেললেই অপমান, তিরস্কার, মারধর ইত্যাদি। তাহলে মাছ বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করা এসব প্রান্তিক জেলেরা যাবেন কোথায়?
তাদেরই একজনের নাম দুলাল মিয়া। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আমাদের বিল-হাওরে আজ জাল ফেলতে পারছি না। সবগুলো বিল-হাওর আজ প্রভাবশালীদের দখলে। তারা প্লাস্টিক জালের বেড়া দিয়ে দিয়ে রেখেছেন। আমরা গরিব জেলেরা জাল ফেলতে গেলেই তাদের লোকজন মারতে আসেন। কখনো কখনো আমাদের জাল কেড়ে নিয়ে যায়। নানাভাবে হয়রানি করে।
এখন তো মাছ বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। এখন বিলে নিজে না গিয়ে নারীদের মাছ ধরার জন্য বিলে পাঠাতে হয় বলে জানান তিনি।
তারা নিজেরা মাছ খাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ। আর সেই পথটি হলো-ঘর গেরস্থালি সামলানো নারীরা আজ নেমে এসেছেন বিলে। তারাও পুরুষের মতই বিলের কাঁদাময় অবস্থায় নেমে ধৈর্য সহকারে ধরছেন মাছ। এ যেন কুলসুম বিবির মাছের ভাগ্য!
সম্প্রতি হাইল হাওরের পূর্ব অংশের জলাভূমি দেখা গেছে এক মধ্যবয়েসী নারী কর্দমাক্ত মাটিতে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিসমেত মাছ ধরতে ব্যস্ত সময় করছেন। মৎস্য আহরণে গ্রামীণ নারীর এটি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। মাছেভাতে বাঙালির চিরপ্রাচীন উক্তিটিকে দৈনন্দিনভাবে সফল করতে তুলতে এ যেন অন্য অনন্য ফর্মুলা!
অন্য জেলেরা যে জমিটুকুতে কিছুক্ষণ আগে পানি শুকিয়ে মাছ ধরে নিয়ে গেছেন, যেখানেই কুলসুম বিবির ভাগ্যের প্রাপ্তি নির্ধারণ পরীক্ষা। এখানে অবশিষ্ট মাছও তো থাকার কথা নয়, তারপরও দেখা যাক- এই বলেই পরীক্ষায় কাঁদায় নীরবে নেমে গেছেন তিনি। পেয়েছেন হতাশাকে দূর করার মতো কিছু প্রাকৃতিক উপহার।
প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জলজ স্রোতের উচ্ছ্বাস নিয়ে হাইল হাওরের প্রাণ। এক সময় প্রায় ৯৮ প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছ পাওয়া গেলেও বর্তমানে বহু মাছ বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির পথে। মেশিন দিয়ে বিল শুকিয়ে মাছ ধরার এই প্রতিযোগিতামূলক অপকৌশল মাছগুলোকে সরাসরি বিলুপ্তির তালিকায় ঠেলে দিয়েছে।
গ্রামের প্রেক্ষাপটে এমন ব্যতিক্রমী মৎস্য শিকারে গ্রামীণ নারীরা নিজেদের নিয়োজিত করেন বটে। তবে তা নিতান্তই ব্যক্তিগতভাবে। আর এই প্রয়াসটি আরও একটু গুরুত্ববহ। নিজের শৈশব স্মৃতিতে লালিত চিরচেনা বিলে মাছ ধরে খেতে পারছেন না বলেই – এই ব্যতিক্রমী পন্থা।
ওই প্রান্তিক জেলের নিকটাত্মীয় কুলসুম বিবি। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হাওর বিলে আগের অবস্থা নেই। আমরা গরিবা মানুষ আজ জাল ফেলতে পারি না। তাই অন্যরা মেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরে নিয়ে যাবার পর ওই জায়গাটুকুতেই আবার আমি মাছ খুঁজতে নেমেছি। প্রায় দুই/তিন ঘণ্টা রোদে পুড়েছি। তবে খারাপ পাইনি, কৈ, খলিশা, লাঠি মাছ (টাকি মাছ) পেয়েছি।
দুপুর গড়িয়ে বেড়ে গেছে রোদের তীব্রতা। এইটুকু কথা বলেই তিনি বাড়ির পথে পা বাড়ালেন। অনেক কষ্ট-অশান্তির ভেতর কিছুটা হলেও আনন্দ তার। তাদের ছোট সংসারের পাতে আজ অনেক দিন পর মাছ উঠবে!