আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ সমাবেশের ভেন্যু বা স্থান নির্বাচন নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাকযুদ্ধ। বিএনপি অনঢ় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালনে। কিন্তু পুলিশ সেখানে নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুুমতি দিয়েছে ২৬টি শর্তে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে চলছে নানা বিতর্ক, বিবৃতি; যা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের রাজনীতিতে। প্রতিটি পক্ষ যদি নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তবে দেশের রাজনীতি কোনদিকে গড়াবে, সেটিই এখন প্রশ্ন সচেতন মহলের। বিষয়টি রীতিমতো শঙ্কা জাগিয়ে তুলছে সাধারণ মানুষের মনেও।
নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) গত ১৩ নভেম্বর চিঠি দেয় বিএনপি। সেখানে তাদের অনুমতি না দিয়ে গত মঙ্গলবার পুলিশ ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, উভয় পক্ষ যদি জেদাজেদি করে তাহলে এক পর্যায়ে সংঘর্ষেরূপ নিতে পারে। তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ি বাক স্বাধীনতা, সভাসমাবেশ করতে পারা, ধর্মীয় অধিকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। শর্তসাপেক্ষে একটি রাজনৈতিক দলকে অনুমতি দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপিকে ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটা কী ধরনের অনুমতি? পুলিশ এই অনুমতি দেওয়ার কে? এটা হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। পুলিশ ও প্রশাসনের এক শ্রেণি একটি পক্ষের কাজ করে। এই অবস্থায় গণসমাবেশের ভেন্যু নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষ যদি জেদাজেদি করে তবে তা দেশের কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।’
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, আমরা চাই, শন্তিপূর্ণ উন্নতসমৃদ্ধশীল এবং সম্প্রতির বাংলাদেশ।
গতকাল বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে বিএনপির সমাবেশ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, সরকার তো কাউকে গন্ডগোল সৃষ্টির জন্য, সারা দেশ থেকে অগ্নিসন্ত্রাসীদের জড়ো করে ঢাকা শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য অনুমতি দিতে পারে না। বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার ক্ষেত্রে সরকার সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যেই তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন ছিল, সেটি এগিয়ে এনে ৬ তারিখ করা হয়েছে, যাতে বিএনপি সেখানে নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে পারে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য তো ভিন্ন। একটি গন্ডগোল লাগানো।
বিএনপির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তারা যদি চূড়ান্তভাবে নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার জন্য তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে, সে ক্ষেত্রে সরকার কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করবে। দেশে যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারায় থাকবে। প্রয়োজনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ অন্য কোথাও নয়, নয়াপল্টনেই হবে। আমরা পল্টনেই সমাবেশ করব। এই সমাবেশে কোনো জেলার কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। বিএনপি কোনো অবস্থান ধর্মঘটেরও ডাক দেয়নি। শুধু সমাবেশ দিয়েছি আমরা। সরকারের তাতেই ভয়।
তিনি আরো বলেন, বিএনপি কিছু গোপনে করে না। করার প্রয়োজনও হয় না। আমরা যা করি বা করব, তা সরাসরি করব। বলে দেব কোন দিন কী হবে। আমাদের দাবি স্পষ্ট, ভোটের অধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি গুম–খুনের বিচার। এটা এখন আর বিএনপির দাবি নয়, দেশের সব মানুষের দাবি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জ্বালানি, তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে গত ৩১ জুলাই কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের আবদুর রহিম নিহত হন। পরে আহত জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আবদুর রহিমও হাসপাতালে নিহত হন। প্রতিবাদে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দিতে দলের নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ দেয়। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। এসব কর্মসূচিতেও পর্যায়ক্রমে নারায়নগঞ্জে যুবদল নেতা শাওন, মুন্সীগঞ্জে শাওন মারা যান। যশোরে বিএনপি নেতা আবদুল আলীমও মারা যান। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের গুলিতে নয়ন মিয়া মারা গেলেও নিজস্ব পরিকল্পনার বাইরে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি।
দলের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, গত অক্টোবর মাসে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। এই সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা এবং সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলা। এই নিয়ে বিএনপিতে শঙ্কাও ছিল। কিন্তু গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ডের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জমায়েত দেখার পর দলটির আগের ধারণাও পাল্টে যায়। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, চট্টগ্রাম সমাবেশের আগে দুই ধরনের শঙ্কা ছিল। এক. সরকারের বাধা; দুই. পলোগ্রাউন্ড পরিপূর্ণ হবে কিনা। এই দুটি বিষয় মাথায় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলেন দলের শীর্ষ নেতা। তাদের নির্দেশনা দেন আগেভাগে চট্টগ্রামে যাওয়ার। দলের শীর্ষ নেতার ফোনে নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, গণপরিবহন ধর্মঘটসহ নানা বাধার শঙ্কা মাথায় রেখে নেতাকর্মীর ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লায় সমাবেশ করে দলটি। একই কৌশলে আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী সমাবেশ করবে। এর ব্যতিক্রম হবে না ঢাকা সমাবেশের ক্ষেত্রে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘ঢাকা অভিযাত্রা’ কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। সেবার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গুলশানের নিজ বাসভবন থেকেই বের হতে দেওয়া হয়নি। ওই কর্মসূচির বেশ কদিন আগে থেকেই খালেদা জিয়ার বাসভবন ঘিরে বালুর ট্রাক রেখে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল। এরপর বিএনপি আর ঢাকায় বড় জমায়েত করতে পারেনি। এই অবস্থায় ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ যে কোনোভাবে সফল হতে চায় দলটি।
আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ঢাকা। বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সরকার সেটি ভেঙে দিতে চাইবে-এটা স্বাভাবিক। সরকারের এই চাওয়া কোনোভাবে সফল হতে দিতে চায় না দলটি। তারা মনে করেন, এই সমাবেশ ব্যর্থ হলে নেতাকর্মীদের মনের ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যা আগামী দিনে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির জন্য বড় একটা ধাক্কা হবে। এই অবস্থায় দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, কর্মসূচি করলেও নেতাকর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে, না করলেও মামলা দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তাদের অবস্থান থেকে সড়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা নেই তাদের।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ওপর সংঘাত চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা তো কোনো ধরনের সংঘাতে যেতে চাচ্ছি না। আমরা অন্যান্য বিভাগের মতো ঢাকার নয়াপল্টনে একটা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাইছি। সেখানে বাধা দেওয়া হলে তা তো মানা সম্ভব নয়।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেন, বিএনপি এই মুহূর্তে সংঘর্ষে জড়াতে চায় না। আবার ঢাকার সমাবেশ সফল করার ব্যাপারেও নেতাকর্মীদের দিক থেকে তারা চাপে আছে। এই সমাবেশ ব্যর্থ করে দিতে সরকার ও সরকারি দল কঠোর অবস্থানে থাকবে। ফলে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের আশেপাশে সমাবেশ করতে পারলে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধা হবে। এ কারণে বিএনপি তার অবস্থান থেকে সরতে চাইছে না। যদিও দলের একটি অংশ সরকারের সাথে এখনই সংঘাতে না গিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার পক্ষে রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা মুখ খুলতে পারছেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আজ আইজিপির সাথে স্বাক্ষাৎ করবে বিএনপি
নয়াপল্টনের আগামী ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলাসহ চলমান পরিস্থিতি নিয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শকের স্বাক্ষাৎ করবে বিএনপি একটি প্রতিনিধি দল। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১ টায় প্রতিনিধি দলটি পুলিশ সদর দপ্তরে এই স্বাক্ষাৎ করবে। বিএনপির প্রতিনিধি দলে থাকবেন বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ও আইন বিষয়ক সম্পাদক
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য জানান, তারা আইজিপিকে বলার চেষ্টা করবেন-এই মুহূর্তে পুলিশ আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গেছে। গত ২২ আগস্টের পর থেকে গত ৩ মাসে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৮ জেলায় ২৬১টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে গত ১০ দিনেই (২৬ নভেম্বর পর্যন্ত) হয়েছে ১৬৫ টি মামলা। প্রতি মুহুর্তে এই হামলার সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার ১১০০ জন নেতাকর্মী গায়েবি মামলায় আগাম জামিন নিয়েছেন। আরো এক হাজার নেতাকর্মী জামিনের অপেক্ষায় রয়েছেন। এ বিষয়গুলি আইজিপিকে অবহিত করবেন। এছাড়াও শান্তিপূর্ণভাবে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে আইজিপি’র সহযোগিতাও চাইবেন তারা।