দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা, জনগণের অনাস্থা এবং তুমুলভাবে বিতর্কিত হওয়ার পরও ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। অথচ তারাই বলেছে, বর্তমানে ইসির যে সামর্থ্য তাতে সর্বোচ্চ ৭৫টি আসনে ইভিএমে ভোট করা যায়।
বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্বে থাকা বিএনপি ইসির এই সিদ্ধান্তে খুব একটা অবাক হয়নি। দলটির অভিযোগ- ইসি সরকারি দলের উদ্দেশ্য হাসিলে কাজ করছে। কারণ আওয়ামী লীগই কেবল ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট চেয়েছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যর মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে এবং দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতাসীন সরকার গত দুই নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে। এবার তারা নির্বাচনে ইভিএমে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় আসতে চায়। তবে এভাবে তাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়া হবে না।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পর তারাও আগের কমিশনের মতো ভোটে ইভিএমের ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। এ যন্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে ৩৯টি দলকে গত জুন মাসে ইসিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে বিএনপিসহ ১১টি দল ইসির আহ্বানে সাড়া দেয়নি। যে ২৮টি দল সাড়া দেয়, তারাও আলোচনায় ইভিএমের কারিগরি দিক পর্যালোচনার চেয়ে রাজনৈতিক দিককেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। জুন মাসে অনুষ্ঠিত ইসির ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি- এ চার দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট চেয়েছে। এ ছাড়া তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বিএনএফ, জাকের পার্টি ও এনপিপি কিছু আপত্তি সত্ত্বেও ইভিএমের পক্ষে বলেছে।
ইভিএম নিয়ে ইসির মতবিনিময় অনুষ্ঠানে যায়নি বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। এসব দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে বক্তব্য দিচ্ছে।
শুরু থেকেই ইভিএমের ঘোরতর বিরোধিতা করে আসছে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। তাদের অভিযোগ, এটি নীরবে ভোট চুরির যন্ত্র। দলটি বলছে, তারা ইসি কিংবা তাদের নেয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়, কারণ ইসিতে তাদের আস্থা নেই। তাদের মূল দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাই তারা ইসির সাথে সংলাপে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। তারপরও যারা সংলাপে অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দল ইভিএম চায় না। আমরা তো এটা চাইই না।
ইভিএমে দুর্বলতা তুলে ধরে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ইভিএম মানুষ তৈরি করেছে। মানুষ এটাকে যেভাবে কমান্ড দেবে, সে অনুযায়ী চলবে। এটাই সফটওয়্যারের নিয়ম। ভোট দেবেন ধানের শীষে, চলে যাবে নৌকায়- এটা খুব কঠিন কিছু নয়। দেশের ইভিএম মেশিনে ভোটের পর পেপার দেয়া হয় না। অন্যান্য দেশে এটা দেয়া হয়। একজন ভোট দেওয়ার পর যে কাগজ আসে তাতে দেখতে পান, তিনি কত নম্বর ভোটার, কাকে ভোট দিলেন। অথচ এ ব্যবস্থা দেশের মেশিনে নেই। অর্থাৎ প্রথম থেকেই ইভিএমের উদ্দেশ্য হচ্ছে ডাকাতি। বিএনপি ইভিএম নিয়ে অনাস্থার বিষয়টিই বারবার সামনে আনার চেষ্টা করছে।
ইসির মতবিনিময়ে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপাসহ ১৮টি দল ইভিএম নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের পাশাপাশি নানা প্রশ্ন তুলে ধরে।
মানুষের আস্থা না থাকা, ভোট দিতে দেরি হওয়া, অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলা- এসব কারণে ইভিএমের বিরোধিতা করছে জাতীয় পার্টিও। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, ইভিএমে আমাদের আস্থা নেই। মানুষ মনে করে, ইভিএমে ভোট পাল্টে দেয়া হলে কিছু করার নেই। কারণ ফল রিচেক (পুনঃপরীক্ষা) করা যায় না।