বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ সরবরাহ দেশব্যাপী বড় মাত্রায় কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিশ্ববাজারে দাম চড়া হওয়ায় খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি কেনা বন্ধ রাখার বিষয়কে তুলে ধরা হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তবে কবে নাগাদ পরিস্থিতির উন্নত হতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
দেশের যে এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, তার মধ্যে উত্তরের জেলা শহর বগুড়া থেকে একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সুলতানা পারভিন জানান, তাদের শহরে গত শনিবার থেকে ২৪ ঘণ্টায় ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। যদিও বগুড়ায় আগে দিনে বিদ্যুতের লোডশেডিং হতো অল্প সময়ের জন্য।
তিনি বলেন, ১০ মিনিট বিদ্যুৎ থাকলে আধা ঘণ্টা থাকছে না। আবার ২০ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ এলে তারপর এক ঘণ্টা থাকছে না। এভাবে চলছে। এর গড় করলে ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে সাত বা আট ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ পাচ্ছি।
তিনি বগুড়ায় যে কলেজের অধ্যক্ষ, ওই কলেজে একটি আবাসিক হোস্টেলে উচ্চ মাধ্যমিকের ২১ জন শিক্ষার্থী থাকেন।
পারভিন বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে একদিকে হোস্টেলের শিক্ষার্থী এবং অন্যদিকে বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘বাসায় আমার বাচ্চা ও অসুস্থ বয়স্ক লোক নিয়ে বিদ্যুতের অভাবে করুণ অবস্থায় আছি। অন্যদিকে কলেজের হোস্টেলে ছাত্রদেরও চরম ভোগান্তি হচ্ছে।’
বগুড়ার পাশাপাশি রংপুর অঞ্চল, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহীসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলা থেকে লোডশেডিংয়ের ব্যাপকতার চিত্র পাওয়া গেছে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোতেও ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। সিলেট ও নোয়াখালী অঞ্চলে গ্রাহকরা তিন চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। রাজধানী ঢাকাতেও বিভিন্ন এলাকায় দু’দিন ধরে দিনে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে।
কর্মকর্তারা দাবি করেন, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হওয়ায় চার বছর ধরে কোনো লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু দু’দিন ধরে দিনে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহে ১২০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে।
গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হচ্ছে না। সেজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম প্রচুর বেড়ে গেছে। সরকার যে পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে, সেটা দিয়েও কাভার করা যাচ্ছে না। তিনি জ্বালানির বিশ্ববাজার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, গ্যাসের দাম এখন আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে প্রতি ঘনফুট ৩৬ ডলার হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু এই পরিমাণ টাকা দিয়ে আমি গ্যাস আনতে পারছি না, সেজন্য আমাকে এই ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।’
গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোতে এখন অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও কর্মকর্তারা বলেন, জ্বালানি তেলের দামও বিশ্ববাজারে অনেক বেশি হওয়ায় পেট্রলিয়াম করপোরেশনকে দিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে। সেজন্য তেল-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পুরো দমে চালানো হচ্ছে না।
সরকার এই পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করেন সাংবাদিক অরুণ কর্মকার।
তিনি মনে করেন, দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে ব্যর্থতার কারণে তা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি বা যেকোনো কারণে যেকোনো সময় জ্বালানির বিশ্ববাজার অস্থির হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু তেল আমাদের নেই। ফলে তা আমদানি করতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্যাস ও কয়লা সম্পদের অনুসন্ধান, উত্তোলন বাড়াতে সরকারের উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। ওই কারণে আমরা গ্যাসের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি এবং এখন এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে রাজি নন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি দাবি করেন, গত চার বছরে এক হাজার ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে।
তবে এখন বিশ্ববাজারে দাম চড়া হওয়ায় গ্যাস কেনা বন্ধ করায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে, এই অবস্থার সহসাই উন্নতি সম্ভব কিনা-এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘গ্যাস কেনাটা বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। গ্যাসের দাম কমলে হয়তো গ্যাস আমদানি করতে পারবো। সরকার যদি এখন গ্যাস আমদানি করত, তাহলে আমরা করবো। আর তা না হলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চুক্তির ভিত্তিতে যে গ্যাস পাওয়া যায়, তার সাথে আভ্যন্তরীণ গ্যাস দিয়ে এভাবেই চলবে।’
তার কথায় এটা পরিষ্কার, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমার অপেক্ষায় থাকবে সরকার এবং এমুহূর্তে বিকল্প উপায় নেই।
সরকার যখন সারা দেশে শত ভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার কথা বলছে, তখন আবার লোডশেডিং গ্রাহকদের অতীতের খারাপ পরিস্থিতিকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সূত্র : বিবিসি