বিগত পনেরো বছরে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা চরম দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ব্যাংকিং খাতে নেমে এসেছিল বড় ধরনের বিপর্যয়; উন্নয়ন প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব ছিল প্রকট। জনসেবা, উৎপাদনমুখী শিল্প ও প্রশাসনিক কার্যক্রমেও দেখা দেয় অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ২৯ আগস্ট সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করে। দীর্ঘ গবেষণা ও পর্যালোচনার পর কমিটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্বেতপত্র জমা দেয়।
অন্যদিকে, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি তিন মাস কাজ শেষে ৩০ জানুয়ারি ৫২৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। তবে দুটি প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় কমিটির সদস্যদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তাঁদের মতে, সরকার এখনও অর্থনৈতিক সংস্কারকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
টাস্কফোর্স কমিটির মূল সুপারিশ
কমিটি সতর্ক করে বলেছে, বুড়িগঙ্গা নদী বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে; তাই নদী ও রাজধানী ঢাকাকে টিকিয়ে রাখতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত সংস্কারে করা সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ কমপ্লায়েন্স বিভাগ শক্তিশালী করা, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কাঠামো তৈরি, বিএফআইইউ সংস্কার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত, অর্থঋণ মামলার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করা।
সামগ্রিক সংস্কারের অংশ হিসেবে স্থায়ী রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন, এনবিআরের ওপর ওভারসাইট কমিটি গঠন, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ কৌশল এবং বিনিয়োগ বাড়াতে পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এনবিআরকে দুই ভাগ করা হলেও এতে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং অন্যান্য বিষয়ে নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। স্বাস্থ্যসেবা, সড়ক পরিবহন ও বিমান সেবায় মনিটরিং বৃদ্ধি এবং তদারকিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশও করা হয়েছিল।
শ্বেতপত্রের অনুসন্ধান ও প্রস্তাব
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিটি ৩৯৭ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক অর্থপাচার, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাটের চিত্র তুলে ধরে।
শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে- বিদেশে পাচার হয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার (বর্তমান বাজারদরে ২৮ লাখ কোটি টাকা), সরকারি প্রকল্পে ঘুষ লেনদেন হয়েছে ১.৬১ লাখ কোটি থেকে ২.৮০ লাখ কোটি টাকা, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ের ৪০% পর্যন্ত অপচয় ও লুটপাট, ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, শেয়ারবাজারে আত্মসাৎ ১ লাখ কোটি টাকা। এই অনিয়ম বন্ধে কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে কমিটি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, শুধু ‘এগোচ্ছি’ বললে চলবে না, দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রয়োজন। “রাতারাতি সব হবে না; কিন্তু প্রতিদিন কিছু না কিছু অগ্রগতি জরুরি,” মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দুটি বড় সংস্কার প্রতিবেদন জমা পড়ার পরও সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই- এটি উদ্বেগজনক। তার মতে, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া টেকসই প্রবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরাসরি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বাণিজ্য সহজীকরণে যেসব সুপারিশ সহায়ক, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নিলে কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে বলে তিনি আশা করেন।