সরকার খরচের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করলেও পরিচালনা ব্যয়ে চাপ রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ পরিচালন খরচ আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ কমেছে। সুদ পরিশোধ ও ভর্তুকি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংক একীভূতকরণে মূলধন সহায়তা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন ভাতা বাড়ানোর কারণে পরিচালন ব্যয়ের আকার মূল বাজেটে ঘোষিত অঙ্কের চেয়ে কিছুটা বাড়তে পারে। তাই এবার সামগ্রিক মূল বাজেট খুব একটা কাটছাঁট হবে না। তবে আগের অর্থবছরের তুলনায় কমিয়ে ধরা উন্নয়ন বাজেটে আরেক দফা ছুরি চালানো হবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের খরচের চাপ বাড়ছে। কারণ বেতন-ভাতা, সুদ পরিশোধ, ভর্তুকিতেই বাজেটের সিংহভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। নির্বাচন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছেন না। আগামী কয়েক মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির স্থবিরতা কাটবেÑ এমন প্রত্যাশাও কম।
এদিকে বাজেট বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ সূত্রের তথ্যমতে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট সরকারি ব্যয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৮ কোটি টাকা। প্রথম প্রান্তিকে সুদ ও ভর্তুকির জন্য ৫৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই
বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। অথচ এ সময়ে উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) বরাদ্দ মাত্র ৫ দশমিক ০৯ শতাংশ। অবশ্য এটা আগের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার পেছনে একটা কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। তবে আরও বড় কারণ, সরকার উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে। আবার যেটুকু বরাদ্দ রেখেছে সেখানেও খরচ করতে পারছে না নানা কারণে। কিন্তু পরিচালন খাতের ব্যয় আটকে রাখা যায় না। ফলে এ ব্যয় বেড়েছে। এটা আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
দেশের বর্তমান আর্থিক চিত্র অনুযায়ী, সরকার ঋণ শোধের চাপ সামলাতে গিয়ে উন্নয়ন ব্যয় বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ছে। রাজস্ব ব্যয় ক্রমেই অপ্রযোজ্য খাতে বাড়ছে, অথচ সামাজিক খাত, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের ঘাটতি বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য ঝুঁকিতে পড়বে; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতেই চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য কমিয়ে ধরা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। যদিও সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখনও তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা থাকায় সরকার এ মাসের মধ্যে বাজেট সংশোধন চূড়ান্ত করবে। এর অংশ হিসেবে অর্থ বিভাগ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছ থেকে সংশোধিত বরাদ্দ প্রস্তাব জমা নিয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
গত জুলাই থেকে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কার্যকর হওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ভাতা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানো হয়েছে। ফলে পরিচালন ব্যয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বাড়বে। এজন্য চাপ কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করবে নির্বাচিত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার শুধু ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে যাবে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাজেটে প্রাক্কলনের চেয়ে ব্যয় বাড়তে পারে। নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত তহবিল লাগতে পারে। এদিকে পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে নতুন ব্যাংকে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগান দিচ্ছে সরকার। এসব কারণেই পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।