দেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০৭ জনের। গত ৭ দিনে মারা গেছেন ২৯ জন, আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৬৫২ জন। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূক বেশি। এ তো গেল সরকারি হিসাব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন বারোমাসি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবে এই সমস্যার শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। তারা বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে সম্মিলিত প্রয়াস চালানো দরকার। দ্রুত মশক নিধন এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও ব্যাপক পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত একদিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৮৮ জন। তবে এ সময়ে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৫৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৬ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৮৪ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৮৯ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৪৫ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৬ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে) নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এ ছাড়া গত এক দিনে সারাদেশে ৫৭৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৭২ হাজার ৯৬৬ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৭৬ হাজার ৫১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০৭ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ডেঙ্গু-বিষয়ক সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির গত এক সপ্তাহের অর্থাৎ ১ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত হিসেবে দেখা যায়Ñ ডেঙ্গুতে ১ নভেম্বর আক্রান্ত ৬৫১ জন, ২ নভেম্বর ৫ জনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত ১ হাজার ১৬২ জন; ৩ নভেম্বর মৃত্যু ৫ জন, আক্রান্ত ১ হাজার ১৪৭; ৪ নভেম্বর মৃত্যু ৪, আক্রান্ত ১ হাজার ১০১; ৫ নভেম্বর মৃত্যু ১০, আক্রান্ত ১ হাজার ৬৯ এবং ৬ নভেম্বর মৃত্যু ৫ জন ও আক্রান্ত ১ হাজার ৩৪ এবং ৭ নভেম্বর আক্রান্ত ৪৮৮ জন। সব মিলিয়ে চলতি মাসের ৭ সাত দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৬৫২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর আসল তথ্য নেই : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেই পর্যায়ে গেছে সেটি জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা বলা যেতে পারে। পাশের দেশ ভারতের পশ্চিবঙ্গসহ অনেক দেশই ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পন্থা বেছে নিয়েছে। যেসব জায়গায় মশার উপদ্রব বেশি সেসব জায়গায় ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখাÑ এ ধরনের রুটিন কাজ করলেও এ সংকট অনেকাংশে সমাধান হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হয় ২০০০ সনের দিকে। তখন থেকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য যেসব কার্যক্রম সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করা দরকার ছিল; সেটি গ্রহণ করা হয়নি। অকার্যকর অর্ধকার্যকর এবং প্রদর্শনবাদী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘এ বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা নেতিবাচক বার্তা দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মানে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টা এমন যেন ডেঙ্গু হয় হোক, মানুষ মারা যাবে যাক। ফলে ডেঙ্গু কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে এবং সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রতিদিন সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যাটা বলা হয়। এটা কিন্তু প্রকৃত চিত্র নয়। কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সারাদেশে সব হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সংগ্রহ সংবাদ সংগ্রহ করে না। ডা. লেনিন মনে করেন, যে হারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে, ভুগছে, তাদের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, জীবনহানি হচ্ছে, এটি মানুষের মনে এক ধরনের ভীতির তৈরি করেছে। এ কারণে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার সময় এসছে।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুর এখন সারা বছরের রোগ হয়ে গেছে। মশা যদি নিয়ন্ত্রণ না করেন ডেঙ্গু কমানো সম্ভবই না। ফলে যে কারোরই জ্বর হোক, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা এগুলো হলে অবহেলা না করে চিকিৎসা নিতে হবে। এই যে লোক মারা যাচ্ছে মূল কারণ হলো অনেকে দেরিতে আসে। গর্ভবতী মহিলা, কিডনি রোগী, হার্টের রোগী, লিভারের রোগী, স্টোকের রোগী, ক্যানসারের রোগী, তারা সামান্য জ্বর হলেও তারা ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। দ্রুত ডেঙ্গু টেস্টে করিয়ে নিতে হবে। চিকিৎসা তাড়াতাড়ি শুরু করলে এই মৃত্যুর ঝুঁকিটা একটু কমানো যেতে পারে। তিনি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মশক নিধনে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর আমাদের সময়কে বলেন, ‘সবকিছু বিবেচনা করে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে এগুলো সিদ্ধান্ত হয়। আমি তো এটা একা বলতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘টোটাল সংখ্যা বাড়লেও গত বছরের তুলনায় এখন মৃত্যু আরও কম। এতে সন্তুষ্টি হওয়ার কিছু নেই। একটা মৃত্যুও আকাক্সিক্ষত নয়। বিষয়টা হচ্ছে এখানে কয়েকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় আছে। মশক নিধনে স্থানীয় সরকারের একটা দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের নিজেদেরও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে হবে। নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।’
শুধু হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা দিয়ে কিছু হবে না : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ববোধের বিষয়ে ডিজি আবু জাফর বলেন, ‘আমাদের ব্যবস্থাপনা জায়গা থেকে যেখানে যেটা প্রয়োজন সেটা আমরা করছি। ডাক্তারদের অন্য জায়গা থেকে বদলি করে নিয়ে যথাযথ জায়গায় রাখছি। সেলাইনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা হাসপাতালে আশা করি ঠিক আছে। সমস্যা হচ্ছে, বেশির ভাগ রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে আসে না। যখন রোগ জটিল হয়ে যায় তখন আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসাটা যত সহজ হয়, সময় অতিবাহিত হলে ডাক্তারের কাছে গেলে চিকিৎসা দেওয়ার পরও ভালো করা কঠিন। এটাই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার একমাত্র কারণ। সার্বিকভাবে সবাই যদি আমরা সচেতন না হই, শুধু হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা দিয়ে কিছু হবে না।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সরকার চাইলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় সহজ হবে। তবে সরকার যদি মনে করে ঘোষণাটি স্পর্শকাতর, তবে ঘোষণার বাইরে থেকেও জরুরি পরিস্থিতি অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। মূল কথা হলো জরুরি দৃষ্টি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। জরুরি ভিত্তিতে সব সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, না হলে মৃত্যু কমানো যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুসলেহ শাফী নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই) বিভাগের ছাত্র। গতকাল ভোরে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর গ্রামের বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলার চৌধুরী পাড়ায়।