শুক্রবার, ১২:৫৭ অপরাহ্ন, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

শীত যখন পৃথিবী জুড়ে

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫
  • ১০ বার পঠিত

শীতের বাতাস আসতে শুরু করেছে। খুব শিগগিরই আমরা দেখব কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর এবং হাড় হিম শীত। শীত একেক দেশে, একেক মানুষের কাছে একেক রকমভাবে আসে। এ নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

পৃথিবীর ঘূর্ণন ও রূপান্তরের ঋতু

পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং অক্ষের সামান্য হেলে থাকার দরুন, সূর্যের সঙ্গে তার সম্পর্কের ফলেই ঋতু বদল হয়। যখন উত্তর গোলার্ধ সূর্য থেকে দূরে সরে যায়, নেমে আসে শীত তাপমাত্রা হ্রাস পায়, দিন ছোট হয়ে আসে। কিন্তু এই ‘শীত’ শব্দটি পৃথিবীর সব দেশে এক রকম নয়। কোথাও এটি সাদা তুষারের রোমান্স, কোথাও জীবনের সংগ্রাম আবার কোথাওবা নিস্তব্ধ অথচ স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। শীতলতা এক হলেও, এর অনুভব ও প্রকাশের ভঙ্গি ভিন্ন। এই লেখায় আমরা সেই ভিন্নতাকেই স্পর্শ করব, যেখানে শীত একাধারে অভিজ্ঞতাভিত্তিক, তথ্যসমৃদ্ধ এবং মানুষের মানবিক স্পর্শে ভরা এক ‘শীতের বিশ্বচিত্র’ তৈরি করে। আমরা ঘুরে দেখব পৃথিবীর চার কোনায় শীত কেমন অনুভূত হয়, কীভাবে মানুষ ও প্রকৃতি তাকে স্বাগত জানায়।

শীতের রঙে পৃথিবী : ‘যখন তুষারপাত হয়, তখন পৃথিবীটা যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়।’ শীতের আগমন ঘটে পৃথিবীর দৃশ্যপটে এক জাদুকরী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি এক অন্য সময়ের দরজা খোলে, যেখানে প্রকৃতি তার শুদ্ধতম সাদারূপে সেজে ওঠে।

ইউরোপের শুভ্রতা : ইউরোপের শীত মানেই রূপকথার দৃশ্যাবলি। ফ্রান্সে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার যখন তুষারের নরম আবরণে ঢাকা পড়ে, তখন তার নিওন আলোয় এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়। সুইজারল্যান্ডের সুবিশাল আলপস পর্বতমালা পর্বতারোহীদের জন্য এক চ্যালেঞ্জিং সৌন্দর্য। তবে সবচেয়ে মুগ্ধকর দৃশ্যটি হলো নরওয়ের আকাশে। সেখানে শীতের দীর্ঘ রাতে যখন সবুজ, গোলাপি আর বেগুনি রঙের আলোর খেলা চলে, সেই অরোরা বোরিয়ালিস বা মেরুজ্যোতি তখন মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজেই এক বিশাল ক্যানভাসে ছবি আঁকছে।

এশিয়ার নিস্তব্ধ সৌন্দর্য : এশিয়ায় শীতের চিত্র বহুবিধ। জাপানের উত্তরে সাপ্পোরো শহরে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত ‘¯েœা ফেস্টিভ্যাল’, যেখানে বরফ আর তুষার দিয়ে তৈরি হয় বিশাল বিশাল ভাস্কর্য। অন্যদিকে ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা শীতে বরফের চাদরে মুড়ে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ হয়ে ওঠে, যেখানে চিরাচরিত জীবনযাত্রা ধীর ও শান্ত। আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ? এখানে শীত আসে প্রধানত কুয়াশার ধূসর চাদর মুড়ি দিয়ে, শিশিরে ভেজা ঘাস আর ভোরের ঠান্ডা বাতাস নিয়ে। প্রতিটি দৃশ্যই যেন অন্য এক পৃথিবীর দরজা খোলে, যেখানে সময় ধীর হয়ে আসে আর চোখ ভরে যায় প্রকৃতির মহিমায়।

আমেরিকার মহিমা : আমেরিকার উত্তর অংশে শীতকাল বেশ তীব্র। কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাত যখন হিমশীতল বরফের টুকরাগুলোতে আংশিক জমে যায়, তখন সেটির বিশালতা আরও ভয়ংকর সুন্দর হয়ে ওঠে। নিউ ইয়র্ক সিটির সেন্ট্রাল পার্কে জমে থাকা বরফের স্তর এক শহুরে নির্জনতার জন্ম দেয়, যা ব্যস্ত নগরীর মানুষকে ক্ষণিকের জন্য প্রকৃতির কাছে টেনে আনে।

সংস্কৃতি ও উৎসব

শীত মানুষকে একত্র করে। শীতের ঠান্ডা যত বাড়ে, মানুষের ভেতরের উষ্ণতা যেন ততই জমাট বাঁধে। বিশ্ব জুড়ে এই ঋতুতে এমন সব উৎসব পালিত হয়, যা শীতকে সহনীয় করে তোলে এবং মানুষের সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে।

ইউরোপের আলোর উৎসব : শীতকালে ইউরোপের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ক্রিসমাস (Christmas)। ডিসেম্বর এলেই প্রতিটি শহরে ঝলমলে আলো, ক্রিসমাস ট্রি আর মার্কেটগুলো উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিবার, বন্ধু আর উষ্ণতাকে উদযাপন করার এক মাধ্যম। ঘরে ঘরে তখন কেক তৈরি হয়, চলে উপহার আদান-প্রদান এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে এক ছাদের নিচে উষ্ণতা ভাগ করে নেওয়া।

রাশিয়ার নতুন বছরের উদ্দীপনা : রাশিয়ায় তীব্র ঠান্ডা সত্ত্বেও নতুন বছর মানেই বরফে ভরা পথে নাচ, গান আর বর্ণিল আতশবাজি। ঐতিহ্যবাহী ‘ফাদার ফ্রস্ট’ আর তার নাতনি ‘¯েœা মেইডেন’-এর আগমন শিশুদের মধ্যে নতুন আনন্দ সঞ্চার করে। এই উৎসব মানুষের ভেতরের উচ্ছ্বাসকে যেন বরফের শীতলতার ওপরও জয়ী করে তোলে।

বাংলাদেশের পিঠা ও সামাজিক উষ্ণতা : বাংলাদেশে শীত মানেই নবান্ন উৎসব এবং পিঠা উৎসব। পাড়ায় পাড়ায় তখন ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা আর খেজুর রসের ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। গ্রামীণ জীবনে সন্ধ্যায় চুলার পাশে দলবদ্ধ হয়ে গল্প করা, গরম পিঠা খাওয়া আর রোদ পোহানোর দৃশ্য এসব মিলিয়ে শীতকালকে বাংলাদেশে বলা

যায় সামাজিক উষ্ণতার ঋতু। এই উৎসবগুলো এক অর্থে শীতকে সহনীয় করে তোলে, কারণ মানুষের ভেতরের উষ্ণতাই শীতের আসল প্রতিষেধক।

জাপানের প্রথাগত নববর্ষ : জাপানে শীতের শুরুতে পালিত হয় নববর্ষ (Shōgatsu)| । এ সময় মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা এবং বিশেষ খাবার ‘ওসেচি’ খাওয়া সেখানকার সংস্কৃতিকে এক নতুন মাত্রা দেয়। এই প্রথাগুলো জাপানিদের জীবনযাত্রায় এক নিস্তব্ধ শৃঙ্খলা এবং পবিত্রতা নিয়ে আসে।

ঠান্ডার ভেতর উষ্ণ থাকা

শীত শুধু আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়, এটা জীবনযাপনের রূপ বদলে দেয়। ঠান্ডার তীব্রতা যত বাড়ে, মানুষ ততটাই নিজেদের উষ্ণ রাখার জন্য নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে। এই কৌশলগুলো শুধু শারীরিক উষ্ণতা দেয় না বরং এক ধরনের মানসিক শান্তিও এনে দেয়।

নরওয়ের ‘হিউগা’ Hygge) দর্শন : স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়েতে জীবনযাত্রার মূলমন্ত্র হলো ‘হিউগা’। এটি একটি ড্যানিশ শব্দ, যার অর্থ হলো আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, উষ্ণতা এবং ভালো থাকার অনুভূতি। শীতকালে নরওয়ের মানুষ মোমবাতির আলো জে¦লে, কম্বলের নিচে উষ্ণ পানীয় পান করে এবং প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে এই হিউগা দর্শনকে উদযাপন করে। এই জীবনশৈলী প্রমাণ করে, ঠান্ডা আবহাওয়াতেও মানসিক শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।

কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘ওন্দল’ : শীতকালে উষ্ণ থাকার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থা হলো ‘ওন্দল’ (Ondol)। এটি হলো মেঝের নিচে তৈরি করা এক ধরনের হিটিং সিস্টেম, যা ঘরকে ভেতর থেকে উষ্ণ রাখে। এই ওন্দল ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে কোরিয়ানদের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যেখানে মেঝেতে বসে বা ঘুমিয়েও তীব্র ঠান্ডা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও গতি : শীতকালে মানুষের পোশাকের রঙ সাধারণত গাঢ় হয়, কারণ তা তাপ শোষণ করে। খাদ্যাভ্যাসে আসে পরিবর্তন, ঠান্ডা দেশগুলোতে গরম স্যুপ, স্টিউ এবং উচ্চ ক্যালোরির খাবার প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে খেজুরের রস, গুড় ও পিঁয়াজু-চা-এর জনপ্রিয়তা বাড়ে। এমনকি মানুষের হাঁটাচলার গতিও কমে আসে। শীতে মানুষ একটু ধীর, একটু ভেতরমুখী হয়। জীবনযাপনের এই পরিবর্তন বিশ্ব জুড়ে শীতের তীব্রতাকে মোকাবিলা করার এক সাধারণ কৌশল।

নিস্তব্ধতার ঋতু

‘শীত প্রকৃতির ঘুম নয়, বরং তার ধ্যান।’ শীতকাল প্রকৃতির জন্য এক বিশাল রূপান্তরের সময়। এটি স্থবিরতার ঋতু নয়, বরং বসন্তের জন্য নিজ নিজ প্রস্তুতি। এ সময় প্রকৃতি যেন এক দীর্ঘ নিঃশব্দ প্রস্তুতি নেয় বসন্তের জন্য।

উদ্ভিদজগতের রিক্ততা : শীতের আগমনে গাছের পাতা ঝরে যায়, প্রকৃতি ধারণ করে এক রুক্ষ মূর্তি। এই পর্ণমোচী গাছের পাতা ঝরানোর কারণ হলো নিজেদের তীব্র ঠান্ডা আর পানির অভাব থেকে রক্ষা করা। অন্যদিকে উত্তর মেরুর চিরহরিৎ গাছগুলো বরফের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। নদীর জল জমে বরফে পরিণত হয়, আর বরফের নিচেই জলজ প্রাণীরা তাদের জীবনধারণ করে চলে।

প্রাণীদের শীতনিদ্রা ও পরিযান : বহু প্রাণী শীতের কঠোরতা থেকে বাঁচতে শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশনে চলে যায়। ব্যাঙ, কিছু কাঠবেড়ালী এবং ভালুকের মতো প্রাণী তাদের দেহের বিপাকীয় কার্যকলাপ কমিয়ে দীর্ঘ ঘুম দেয়। এটি প্রকৃতির এক অদ্ভুত কৌশল, যা প্রাণীদের খাদ্য সংকট ও ঠান্ডা থেকে বাঁচায়। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো পাখিদের পরিযান। সাইবেরিয়া, ইউরোপ ও হিমালয় থেকে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অসংখ্য অতিথি পাখি আসে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাশয় ও ভারতের বিলে। তারা তাদের অস্থায়ী বাসস্থানে এক নতুন জীবনচক্র শুরু করে।

মেরুপ্রদেশের জীবন : মেরুপ্রদেশে, যেখানে ঠান্ডা চরম আকার ধারণ করে, সেখানে মেরুভাল্লুকেরা এবং পেঙ্গুইনরা হিমবাহের ওপর টিকে থাকে। তাদের পুরু লোম, চর্বি স্তর এবং বিশেষ অভিযোজন শীতের এই চরমতম স্থানেও তাদের জীবন রক্ষা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে সকালবেলার কুয়াশা আর শিশির ঘাসে মুক্তার মতো চিকচিক করে, যা প্রকৃতির স্নিগ্ধতাকেই তুলে ধরে।

শীত ও নতুন উষার অপেক্ষা

‘শীত শুধু ঠান্ডা নয়, এটা জীবনের এক রূপান্তর।’ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শীতের মানে আলাদা কোথাও জীবনযাত্রা স্তব্ধ, কোথাও উৎসবমুখর, আবার কোথাও নীরব কুয়াশার ছায়া। কিন্তু মূল অনুভূতিটি সর্বত্র এক : নীরবতা, চিন্তা এবং উষ্ণতার খোঁজ।

শীত আমাদের শেখায় ধীর হতে, ভেতরের দিকে ফিরে তাকাতে। যেমন প্রকৃতি তার পাতা ঝরিয়ে, প্রাণীদের শীতনিদ্রায় পাঠিয়ে বসন্তের জন্য তৈরি হয়; ঠিক তেমনি মানুষও শীতের অলস ও নিস্তব্ধ সময়ে নিজেদের নতুন করে সাজানোর প্রেরণা পায়। এই শীতকাল প্রমাণ করে, জীবনের কঠিনতম পরিস্থিতিতেও মানুষ এবং প্রকৃতির ভেতরের উষ্ণতা কখনো হার মানে না। তুষারের নিচে যেমন জীবন লুকিয়ে থাকে, তেমনি আমাদের ভেতরেও সবসময় থাকে এক নতুন উষার অপেক্ষা, যা শীতের অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণতা লাভ করবে। শীতের এই বিশ্বচিত্র আসলে মানুষের টিকে থাকা, আনন্দ করা এবং নতুনভাবে শুরু করার এক অবিরাম গল্প। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে শীতের আচরণ এবং রূপে বদল এসেছে। এই বদলকে বুঝতে হবে আমাদের সবারই। কী করে এই বদলের মন্দ দিকগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে সে নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com