সুদানে অনেকদিন ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধ হঠাৎ করে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি একটি হাসপাতালে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় চার শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে আলোচনা শুরু হয় দেশটির পরিস্থিতি নিয়ে।গত সপ্তাহে আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) শহরটি দখল করার সময় কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ মানুষকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে শুধু একটি হাসপাতালেই ছিল প্রায় ৪৬০ জন।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহর দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানিয়েছেন, দারফুরে ত্রাণ কার্যক্রম জোরদারের জন্য সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা অনুমোদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ৪৫০ জনেরও বেশি রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী ও বেসামরিক নাগরিককে হত্যার ঘটনায় তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
সুদান বিশেষজ্ঞ শায়না লুইস এই হত্যাযজ্ঞকে অত্যন্ত মর্মান্তিক বলে উল্লেখ করে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই গণহত্যার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করা হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি আরও জানান, মহাকাশ থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট চিত্রেও রক্তাক্ত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে—বিশাল এলাকায় লালচে রঙে ঢেকে আছে মাটি।
সহিংসতায় জর্জরিত এল-ফাশের শহরে এখনো খাদ্য, পানি ও ওষুধের চরম সংকট চলছে বলে মানবিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে।
সংকটের শুরু যেভাবে
১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় উত্তেজনা চলছিল। মূলত তারই সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
সে সময় বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। সেই বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। তবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন থামেনি। জনদাবিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তার ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন এবং তা একসময় বিরোধে পরিণত হয়। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
আরএসএফ কী?
আরএসএফ গঠিত হয় ২০১৩ সালে। যে কুখ্যাত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে দারফুরে নৃশংস গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্য থেকেই এই বাহিনী গড়ে ওঠে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আরএসএফ মাসালিত ও অন্যান্য অ-আরব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা এটিকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
২০১৩ সালের পর থেকে জেনারেল দাগালো আরএসএফকে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। এ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি সুদানের কিছু সোনার খনিরও নিয়ন্ত্রণ করেন। অভিযোগ রয়েছে যে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ সোনা পাচার করেন।
সুদানের সেনাবাহিনী আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আরএসএফকে সমর্থন দেওয়া ও ড্রোন হামলা চালানোর অভিযোগ করেছে। যদিও আমিরাত তা অস্বীকার করেছে।
আরএসএফ এখন প্রায় পুরো দারফুর এবং পাশের কর্দোফান প্রদেশের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। সেখানে আরএসএফ একটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার গঠন করে। এতে করে দেশটিতে দ্বিতীয়বারের মতো বিভাজনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে।
মিশর ও আমিরাতের ভূমিকা
এখনো সুদানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সামরিক বাহিনী। তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো মিশর, যার সঙ্গে সুদানের অভিন্ন সীমান্ত ও নীল নদের পানি ভাগাভাগির সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে আরএসএফকে অর্থায়ন করে আরেক মুসলিম দেশ আমিরাত।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ কী বলছে
তবে দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে জেনারেল দাগালো এবং পরে জেনারেল বুরহানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাদের বক্তব্য ছিল আরএসএফ ও সহযোগী মিলিশিয়ারা গণহত্যা করেছে। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ঙ্কেন বলেছিলেন, আরএসএফ জাতিগত সহিংসতার ভিত্তিতে পুরুষ, বালক ও শিশুদের পদ্ধতিগতভাবে হত্যা করেছে এবং নারীদের ওপর জঘন্য যৌন সহিংসতা চালিয়েছে।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা যদিও সেখানে গণহত্যা ঘটেছে, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি; তবে তারা নিশ্চিত করেন যে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী উভয়ই যুদ্ধাপরাধ করেছে।