ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। গত ২২ এপ্রিল এ উপত্যকায় পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে ২৬ জন নিহত হন। এ ঘটনার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় ভারত। পাকিস্তান এ হামলায় দায় অস্বীকার করে এর আন্তর্জাতিক তদন্ত চাওয়ার পাশাপাশি পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যেই পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী তীব্র বাকযুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়েছে। সীমান্তের এক প্রান্তে যেমন ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ দাবি জোরালো হয়েছে, তেমনই অন্য প্রান্তে ‘সমুচিত জবাব’ দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই পাল্টাপাল্টি উত্তেজনা যুদ্ধে গড়াবে কিনা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত কি সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটি প্রশ্ন নয়। বরং প্রশ্ন হলো কবে ও কীভাবে হবে? সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন মন্তব্য করেন, ‘প্রতিশোধের ধরন সীমান্তে আক্রমণ বা বিমান হামলা হতে পারে।’ ২০১৬ সালে উরি হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায়। ভারতের দাবি, তারা ওই অভিযানে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি নিশানা করেছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলায় আধা সামরিক বাহিনীর অন্তত ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর বালাকোটে বিমান হামলা করা হয়, যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান ভারতের একটি বিমান ভূপাতিত করে এবং পাইলটকে আটক করে। দুই বছর পর ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। এরপর ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একাধিকবার সশস্ত্র হামলা হলেও যুদ্ধবিরতি অনেকটাই টিকে ছিল।
পেহেলগামে হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হামলাকারীদের পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তাড়া করে খুঁজে বের করে অকল্পনীয় শাস্তি দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানও উপযুক্ত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যদিও এ হামলার জন্য এখনও ভারত পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেনি। তবে ভারত সরকার এরই মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে, যা দেশটিকে দোষারোপ করার একটি স্পষ্ট সংকেত। উল্লেখ্য, পেহেলগামে হামলার পর পরই দায় স্বীকার করে সামাজিক মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিল দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ভারতের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেছেন, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী লস্কর-ই তৈয়বা’র (এলইটি) একটি উপশাখা এই টিআরএফ। তবে গতকাল শনিবার সংস্থাটি এ হামলার দায় অস্বীকার করে জানিয়েছে, এ হামলায় টিআরএফের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও সাজানো প্রচারণা। এটি একটি পরিকল্পিত সাইবার অনুপ্রবেশের ফলাফল, যা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচিত কৌশলের অংশ।
এরই মধ্যে হামলাকারীদের স্কেচ প্রকাশ করেছে ভারত শাসিত কাশ্মীরের অনন্তনাগ পুলিশ এবং তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ হামলার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে পাকিস্তানকে সমর্থন করে বক্তব্য দেওয়ায় দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে একদিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯ জনকে। ভারত এ বিষয়টি নিয়ে কতটা তৎপর, এর একটি উদাহরণ এসব গ্রেপ্তার অভিযান। এখন সামনে ভারতের সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা জানতে চাচ্ছেন, ভারত কি আবার আন্তঃসীমান্ত পদক্ষেপ নেবে এবং পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী হবে? ভারতের কাছে দুটি বিকল্প রয়েছে। প্রথমত, ২০২১ সালের যুদ্ধবিরতি ভেঙে সীমান্তে গোলাগুলি শুরু করা; দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালের মতো বিমান হামলা বা প্রচলিত ক্রুজ মিসাইল দিয়ে আক্রমণ চালানো। তবে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ায় সমীকরণটা বেশ জটিলই।
পেহেলগাম হামলার জেরে এরই মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। এর মধ্যে সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত বন্ধ করা, ভিসা সুবিধা প্রত্যাহার এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করার মতো সিদ্ধান্ত রয়েছে। পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সিমলা চুক্তি স্থগিত, সীমান্ত বন্ধ ও বাণিজ্য স্থগিতের পাশাপাশি তাদের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তান ভারতের কূটনীতিকদের সংখ্যা কমাতে এবং তাদের সহযোগীদের দেশ ছাড়তে বলেছে। পাকিস্তান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোরও ঘোষণা দিয়েছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, ভারত যদি সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে সরে গিয়ে পাকিস্তানের দিকে জলপ্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করে, তবে তা যুদ্ধের পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে। ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় তৈরি হয়েছিল, যা যুদ্ধ, সংকট ও উত্তেজনা সত্ত্বেও বহাল ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান জানিয়েছেন, পেহেলগামের হামলায় বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু এবং ভারতের কঠোর পদক্ষেপের পর পরিস্থিতি আর মধ্যস্তরের উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ নেই। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক এলিজাবেথ থারলকেল্ডও একই মত প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা এখন বেশি। তবে তা কখন হবে, তা স্পষ্ট নয়।
অতীতের অনেক ঘটনাতেই দুই দেশ যুদ্ধের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। ২০০১ সালের সংসদ হামলা এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পরও এমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারতের বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান বিমান ভূপাতিত করেছিল। তবে সেই সময়ও প্রচলিত যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি। কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পানির মতো মৌলিক বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বর্তমান উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার বলেছেন, তার বিশ্বাস ভারত-পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে পরিস্থিতি সমাধান করতে পারবেÑ একভাবে হোক কিংবা অন্যভাবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব পাকিস্তানের ওপর কমে গেছে এবং ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সীমিত হতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দুই দেশ হয়তো উত্তেজনা বাড়ানোর পথ অনুসরণ করবে না। সাবেক সিনেটর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুশাহিদ হুসেন সৈয়দ বলেন, ভারত অতীতের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং এবার তারা সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। তবে যদি এমন কিছু ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হতে পারে, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সোফি আশা প্রকাশ করেছেন যে, দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা হয়তো আর বাড়বে না। তবে যদি ভারত পানি বন্ধ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা বড় ধরনের সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
নানা আলোচনা ও পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের মধ্যেই কাশ্মির সীমান্তে গত ২৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার থেকে গুলি বিনিময় চলছে ভারতীয় সেনা ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সীমান্তের অপর পাশে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে ফাঁকা গুলি ছোড়া শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। এর জবাবে ভারতীয় সেনারাও ফাঁকা গুলি ছোড়া শুরু করে। তবে এতে এ পর্যন্ত হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গতকাল শনিবার দেশটির কাকুলে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পেহেলগামের সাম্প্রতিক এই হৃদয়বিদারক ঘটনা দায় চাপানোর খেলার আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া দরকার। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যেকোনো নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ আর বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে অংশ নিতে প্রস্তুত আছে। উল্লেখ্য, শাহবাজ শরিফ এই বক্তব্য দেওয়ার একদিন আগেই দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পরিচালিত যেকোনো তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
পেহেলগামে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার পর সিন্ধু নদীর পানি ব্যবহারের নানা পরিকল্পনা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ভারত। গত শুক্রবার দিল্লিতে এক বৈঠকে ভারতের পানিশক্তিমন্ত্রী সি আর পাতিল বলেছেন, ‘সিন্ধু নদীর একফোঁটা পানিও পাকিস্তানে যেতে দেব না।’ স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে সিন্ধু অববাহিকার পানি ব্যবহার করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন উপস্থাপনা তুলে ধরা হয় ওই বৈঠকে। এর আগে পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী সরদার আওয়াইস লেঘারি গত বৃহস্পতিবার ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্তের পরিণতি ‘পানিযুদ্ধের’ সমান।
সিন্ধু নদের পানি নিয়ে ভারতকে হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো-ও। গতকাল শনিবার তিনি বলেছেন, সিন্ধু আমাদের আছে, সিন্ধু আমাদের থাকবে। হয় এটি দিয়ে আমাদের পানির স্রোত বইবে, নয়তো তাদের (ভারতীয়) রক্ত বইবে।’ শুক্রবার ভারতের পানিশক্তিমন্ত্রী সি আর পাতিলের বক্তব্যের জেরে এমন হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তান সরকারে থাকা এই নেতা।
এদিকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে গত শুক্রবার মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব ও ইরান। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান দেশ দুটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথকভাবে ফোনে কথা বলেন। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ইসহাক দার সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন এবং উত্তেজনা বাড়াতে পারে- এমন পদক্ষেপ না নিতে আহ্বান জানান। অন্যদিকে এক্স-এ দেওয়া এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেন, তিনি সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পেহেলগামে হামলা ও এর ‘সীমান্ত পারের সংযোগ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। তিনি জানান, বর্তমান সংকটময় সময়ে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির সঙ্গে তেহরানের ভালো সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে সমঝোতা গড়তে ইরান প্রস্তুত। পরে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে ইরানের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন।