প্রবাসে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় বিনোদন সম্ভবত সংগঠন করা। আমেরিকার মতো মুক্ত দেশ, যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস, এমনকি নাগরিকত্ব অর্জনের প্রায় অবারিত সুযোগ রয়েছে, সেখানেও সংগঠনপ্রিয়তা আরও বেশি। বাংলাদেশের প্রতিটি ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের শাখা ছাড়াও শত শত আঞ্চলিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের অস্তিত্ব, দোর্দণ্ড প্রতাপ চোখে পড়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় ও জনবহুল নগরী নিউইয়র্কে। এ নগরীর বাঙালিপ্রধান এলাকা কুইন্স বরোর জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনায় মুখর থাকে সাইডওয়াক ও বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টগুলো।
শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে তার দলের নেতাকর্মীদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন বা দৌড়ের ওপর আছেন। কিন্তু নিউইয়র্কের বাঙালিপ্রধান এলাকাগুলোতে তারা সরব। পতনের পর প্রথম মাসগুলোতে নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা মানববন্ধন করেছে, শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে তার সমর্থকদের উদ্দেশে অনলাইনে ভাষণ দিয়েছেন, গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে এলে আওয়ামী সমর্থকরা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এমনকি গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হোয়াইট হাউজের সামনে সমবেত হয়ে মোদির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপ করতে। ব্যাপারটি অভিনব মনে হলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ইতিহাসের সব পর্যায়ে এ ধরনের কর্মই করে এসেছে।
প্রবাসে, বিশেষ করে যেসব দেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে মূলধারার রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে, সেখানেও কেবল আওয়ামী লীগ নয়, অন্যসব দলের অনুসারীরা দেশের রাজনীতি নিয়েই নিজেদের ব্যতিব্যস্ত রাখতে পছন্দ করেন। এমন অনেক অভিবাসী বাংলাদেশি রাজনীতিক আছেন, যারা বাংলাদেশে সংসদ-সদস্য, মন্ত্রী বা অন্য কোনো লাভজনক সরকারি পদ হাসিলের আশায় বিদেশি নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন না। গ্রিনকার্ড বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার অনুমোদন পেয়ে তক্কে তক্কে থাকেন কখন বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তারা যে দলের অনুসারী সেই দলের মনোনয়ন বাগিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সম্ভবত আমেরিকা থেকে এ ধরনের সুযোগ নেওয়ার বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেশি।
আমেরিকায় সিংহভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী আমেরিকান ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ধার ধারেন না। তারা চাকরি করেন, ব্যবসা করেন, বাড়ি কেনেন এবং অবসর সময় কাটান আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে নিজেদের জড়িত করে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা সর্বাধিক। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় উৎসাহী বাংলাদেশিরা দাবি করেন, নিউইয়র্কে কমপক্ষে পাঁচ লাখ বাংলাদেশির বসবাস। বাংলাদেশের সব এলাকার লোকজন আছে এখানে এবং প্রতিটি জেলার অভিবাসীদের সংগঠন তো আছেই; অনেক উপজেলা, এমনকি ইউনিয়নেরও অভিবাসী সংগঠন আছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আছে। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক অফিসারদেরও প্রবাসী সংগঠন আছে। ধর্মীয় সংগঠন ও মসজিদের নামে পৃথক সংগঠনও অনেক। এক সংগঠন ভেঙে চার সংগঠন, এক মসজিদের কমিটি ভেঙে স্বল্প দূরত্বে চারটি বাংলাদেশি মসজিদ স্থাপনের দৃষ্টান্তও রয়েছে। অন্য কোনো দেশের অভিবাসীদের এত বিপুলসংখ্যক সংগঠন নেই আমেরিকায়।
আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে যে অভিবাসীদের আরও সেবা দেওয়া এবং স্বদেশের স্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা সম্ভব, তা এখন পর্যন্ত খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসীর মাথায় প্রবেশ করেছে। এজন্য সবচেয়ে যা বেশি প্রয়োজন তা হলো, ইংরেজি ভাষার ওপর দখল প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ‘বাংলা ভাষার চেয়ে সেরা ভাষা আর নেই’, সম্ভবত এই মনোভাবের কারণে বহু বাংলাদেশি পাওয়া যাবে, যারা কয়েক দশক ধরে আমেরিকায় অবস্থান করা সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করার ধারেকাছে যাননি। ইংরেজি ভাষা না জানার কারণে তারা আমেরিকান রাজনীতিকদের কথাবার্তা বোঝেন না, বোঝার প্রয়োজনও বোধ করেন না। অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আছে ইংরেজি শেখানোর জন্য, তারা চেষ্টা করেও সফল হয় না। শুধু ভাষার কথা নয়, অনেকে আমেরিকান সিটিজেনশিপ নিয়েও ভোটার হন না। ভোটপ্রার্থীরা তাদের কাছে আসেন, মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন অধিকাংশ বাংলাদেশি ভোটার ভোট দিতে যান না।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম, যারা আমেরিকায় পড়াশোনা করেছে ও করছে, তারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে খুব একটা ভাবে না। কিন্তু যারা বাংলাদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন, তাদের জন্য ইংরেজি ভাষা শেখা জরুরি। নিউইয়র্ক ছাড়াও আমেরিকান অন্যান্য বড় নগরীতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন। এসব নগরী থেকে বাংলা ভাষায় বেশ কিছুসংখ্যক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রবাসী লেখকদের গল্প-উপন্যাসের কাহিনি এবং সাংবাদিকদের লেখা সংবাদপত্রের খবর ও কলামের অধিকাংশই বাংলাদেশকেন্দ্রিক। প্রবাসজীবন ও ভ্রমণ কাহিনিও কিছু আছে, তবে হাতেগোনা। সাধারণভাবে বলা যায়, যারা বাংলাদেশে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাই প্রবাসজীবনের হাজারও ব্যস্ততার মাঝেও তাদের সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। যারা ভালো লিখতেন, অবাধ বাকস্বাধীনতার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে আরও ভালো লিখছেন। অনেকেই মনের দুয়ার খুলে লিখতে পারছেন না। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বই প্রকাশিত হচ্ছে। হওয়ারই কথা, বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ প্রধান ভাষা, প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। নিউইয়র্কের অনেক অফিসের কাগজপত্র, বিশেষ করে বিভিন্ন ফরমে, বোর্ড অফ ইলেকশনের ব্যালটে, নির্দেশনায় ইংরেজি ও অন্যান্য প্রধান ভাষার সঙ্গে বাংলাও থাকে। ট্রেন-বাসেও এখন বাংলায় বিভিন্ন সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেখা যায়।
আমেরিকার মূলধারার সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা অনেক এগিয়েছেন। তারা আমেরিকায় ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করে কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত উঠে গেছেন। আমাদের বাঙালিরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, কয়েক দশক আমেরিকায় বসবাস করেও খুব কমসংখ্যক বাঙালির পক্ষে শুদ্ধ ইংরেজিতে কারও সঙ্গে কথোপকথন সম্ভব হয়। তবে আমেরিকান টানে কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। যেমন, তারা ‘টুয়েনটি’কে ‘টুয়েনি’, ‘টুয়েনটি ওয়ান’কে ‘টুয়েনি ওয়ান’ ইত্যাদি বলতে পারে। শ্বেতাঙ্গদের বলে ‘সাদাইয়া’, কৃষ্ণাঙ্গকে ‘কালাইয়া’ এবং তাদের বিষয় বর্ণনা করতে ব্যবহার করে ‘তুই’। যেমন, “আজ এক সাদাইয়া’কে বললাম, ‘তুই এইটা কর, তুই ওইটা কর’।” একদিকে তারা ইংরেজি আয়ত্ত করেন না, অন্যদিকে তাদের মাতৃভাষায় জং ধরতে থাকে। তারা যে কেবল আমেরিকানদের ভাষা ও রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করে না তা নয়, পাশের বাড়ির শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টাও করে না। অতএব ভাষা চর্চার সুযোগ কোথায়?
খুব কমসংখ্যক সাধারণ বাংলাদেশি আমেরিকানের ঘরে ইংরেজি বই খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রতিবছর নিউইয়র্কে একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু প্রকাশনা সংস্থা নিয়মিত এ মেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রকাশকরা অভিযোগ করেন, বই যা বিক্রি হয়, তাতে তাদের যাতায়াত খরচ ওঠে না। স্থানীয় বাঙালি লেখকদের বইও মেলায় থাকে। তাদের পরিচিতরা চক্ষুলজ্জায় পড়ে তাদের বই কেনেন। লেখকও জানেন, ক্রেতা বই পড়বেন না; ক্রেতাও জানেন, যে বই তিনি কিনেছেন তা তার পড়া হবে না। যারা আমেরিকা, ইউরোপ অথবা বিশ্বের অন্যান্য দেশে যান, তারা জেনেবুঝেই যান যে, যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে তাদের মাতৃভাষা অচল। যে দেশে যে ভাষা প্রয়োজন, সেই ভাষা শেখার চেষ্টা করেন না বলেই তারা পরিচিতির সংকটে পড়েন। এ সংকট সহজে কাটে না বলেই নিজেদের গড়া আঞ্চলিক সমিতি আঁকড়ে থাকেন। আমেরিকায় যারা আসেন, তাদের সিংহভাগই স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে আসেন। বিনামূল্যে ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা থাকলেও আগ্রহ করে কেউ ইংরেজি শেখেন না। ‘ইয়েস, নো, ভেরি গুড’ বলতে পারার মধ্যে অনেকে নিজেদের আটকে রাখেন। আমেরিকায় স্থায়িত্বের শর্ত হিসাবে ইংরেজি ভাষা, দেশটির ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজকে জানতে হয়। নাগরিকত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তারা নির্ধারিত কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করেন। উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেগুলোও ভুলে যান।
একটি ভাষা তখনই মানুষকে আকৃষ্ট করে, যখন তারা একই সঙ্গে সেই ভাষার সৌন্দর্য ও উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পারে। আমাদের অংশের পৃথিবী থেকে মানুষ আমেরিকায় আসে মুখ্যত অর্থ উপার্জন করতে এবং দ্বিতীয়ত নিরাপদে বসবাস করতে এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে। পাশ্চাত্যের যে কোনো দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থ উপার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কারও ফুরসত মেলে না। অনেকে ঠিকমতো ঘুমানোর সময় পর্যন্ত পায় না। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়। অন্যকিছু করার সুযোগ কোথায়? ভাষাই বা শিখবে কখন? শিল্প-সাহিত্যের মতো সৃজনশীল কাজে অর্থ নেই। আমেরিকার মতো দেশে ‘অর্থই সকল সুখের মূল’। তাই অর্থ ছাড়া কেউ কিছু বোঝে না। পিতা তার সন্তানকে কোনো কাজের দায়িত্ব দিলে সন্তান ঘণ্টা হিসাবে অর্থ আদায় করে। এমন পরিবেশ মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রকাশের অনুকূল নয়। বাংলাদেশিরা তাদের গড় জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শ্রমসাধ্য কাজকর্ম করে এবং অর্থ উপার্জন করা ছাড়া আমেরিকার সমাজ-সংস্কৃতি থেকে সামান্যই গ্রহণ করে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আমেরিকায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা যত দ্রুত চেষ্টা করবেন, তারা নিজেদের এবং জন্মভূমির জন্য তত বেশি অবদান রাখতে পারবেন।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : সিনিয়র সাংবাদিক, অনুবাদক