ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছরেও ঘটনার নেপথ্যের কারণ উদ্ঘাটন হয়নি। ধরা পড়েনি নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের পেছনের কুশীলবরা। এ ছাড়া অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি এ দীর্ঘ সময়ে। কেন বিদ্রোহ থেকে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল বিপথগামী বিডিআর জওয়ানরা; কী কারণে পিলখানার ভেতরে সেনা অভিযান চালাতে দেওয়া হয়নি। বিদ্রোহের আগাম তথ্য পেয়েও কেন প্রশাসন ঠেকাতে উদ্যোগী হয়নি- ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের তদন্তে এ ধরনের অনেক প্রশ্নের জবাবই ধাপে ধাপে খোলাসা হচ্ছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।
নারকীয় ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজন, বেঁচেফেরা কর্মকর্তা, এমন কী বিডিআর সদস্যদের অনেক স্বজনও মনে করেন- ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পরিকল্পিত হত্যাকা- চালানো হয়, যে হত্যাযজ্ঞের নিশানা ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। যে কারণে দাবি আদায়ে অফিসারদের জিম্মি না করে খুঁজে খুঁজে তাদের হত্যা করা হয়। তাদের দাবি, এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল।
স্বাধীন তদন্ত কমিশন, বেঁচেফেরা সেনা কর্মকর্তা, বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের আয়োজন চলছিল ঘটনার অন্তত দুই সপ্তাহ আগে। বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারীরা দফায় দফায় তৎকালীন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেন। দেখা করেন শেখ সেলিমের সঙ্গে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকেও ঘটনার দুই দিন আগেই বিদ্রোহীরা তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন। বিদ্রোহের আগাম তথ্য জানতে পারে ডিজিএফআইসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাসহ তখনকার প্রশাসন বিদ্রোহ ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি, যার ফলে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়। এত কিছু জানার পরও প্রশাসন কেন নিশ্চুপ ছিল- এখন এটাই বড় প্রশ্ন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বিডিআর বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনী ও র্যাবের বিপুল সদস্য পিলখানার ভেতরে ‘অপারেশন রিস্টোর অর্ডার’ অভিযান পরিচালনার সব আয়োজন সম্পন্ন করে; কিন্তু তৎকালীন সরকারপ্রধান দেশে গৃহযুদ্ধ লাগার আশঙ্কার অজুহাত দেখিয়ে পিলখানায় সেনা অভিযান চালাতে দেননি। পরে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির কোনোটিকেই স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটিকে বাধাদান ছাড়াও নানাভাবে অসহযোগিতা করা হয়। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর গঠিত পৃথক ওই দুই তদন্ত কমিটি বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ বের করতে পারেনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়- অপারেশন ডালভাতসহ বিডিআরের দাবি-দাওয়া নিয়ে পুঞ্জীভূত ক্ষোভই বিদ্রোহের প্রাথমিক কারণ। প্রকৃত কারণ বের করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার আর কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি করেনি। উচ্চ আদালত একটি কমিশন গঠন করতে বললেও তা করেনি শেখ হাসিনা সরকার।
বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ বের করতে না পারলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়- বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে বাইরের কোনো গোষ্ঠী, দল বা চক্রের ইন্ধন খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এমন ঘটনা ঘটানো হয়। সেনা অভিযান না হওয়ায়, তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ঘটনার ১৬ বছর পর বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকা-ে দেশি-বিদেশি ইন্ধন বা ষড়যন্ত্র থাকার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে। বর্তমান সরকারও তদন্ত করে প্রকৃত কারণ তা খুঁজে বের করতে বলেছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনকে।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর দরবার হল থেকে বেরুনোর পরই আক্রান্ত হন তৎকালীন লে. কর্নেল আব্দুল সালাম। গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে ফেরেন তিনি। আব্দুল সালাম পিলখানা হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, তিনি আধমরা অবস্থায় বিডিআর জওয়ানদের হাত থেকে কোনোরকম প্রাণে রক্ষা পান। তার প্রশ্ন- জওয়ানদের ক্ষোভ ছিল সেনা কর্মকর্তাদের ওপর। তাহলে তারা কেন তার হাসপাতালের একজন সিভিলিয়ান ডাক্তারকে হত্যা করল। কেন আহতদের চিকিৎসায় বাধা দিল। এটা আসলে বিদ্রোহ ছিল না; বলা যেতে পারে পরিকল্পিত হত্যাকা-।
পিলখানা থেকে বেঁচেফেরা একাধিক সেনা কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের পর সেনা অভিযান পরিচালনা করা হলে আরও সেনা অফিসারের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হতো। তাছাড়া নারী-শিশু ও বেসামরিক লোক নিগ্রহ-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেত। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় সেনা অভিযান চালাতে দেওয়া হয়নি।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, বিদ্রোহের পর সেনা অভিযান হলে অনেক সেনা কর্মকর্তার জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো। এমনকি র্যাবও যদি অভিযান করত, তাহলেও হতাহত অনেক কম হতো। ঘটনার পর পরই প্রথম র্যাবের বিশাল বহর সেখানে ছুটে গিয়েছিল।
গত বছর দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ এবং বিদ্রোহের পর বিডিআরের নতুন মহাপরিচালকের দায়িত্বে আসা তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইনুল ইসলাম (লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পরবর্তীকালে অবসরে যান) বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খোলেন।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, ক্যাপ্টেন শফিকের নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য পিলখানায় পৌঁছান সকাল ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তা পাননি। তাকে যদি অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে তিনি সহজেই ওদের কনটেন্ট করতে পারতেন।
বিডিআরের সাবেক ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পিলখানার পরিস্থিতি বিশেষ করে অস্ত্রাগারের পরিবেশ দেখে পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছিল, এটি পরিকল্পিতভাবেই ঘটানো হয়েছে এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার পেছনের লোকজন ২০-২১ দিন আগেই এখানে অবস্থান করছিল। তিনি আরও বলেন, গ্রেনেডের ভেতরে ফিউজ দেওয়া। মানে রেডি টু ইউজ (ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা)। এটা কী করে সম্ভব। গ্রেনেড এবং ফিউজ আলাদা বক্সে থাকে। এটি ছিল অস্বাভাবিক ঘটনা। এ রকম অনেক বক্স ছিল। এটি আগে থেকেই রেডি করা ছিল। তার মানে আগে থেকেই ভেতর থেকে কেউ এ কাজ করেছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে দেওয়া হয়নি। এই সেনা কর্মকর্তার দাবি, পুরো ঘটনার সঙ্গে ভারতের ইন্ধন ছিল।
কুশীলবরা কে কোথায়
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ৫ আগস্টের আগেই ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ইংল্যান্ড পাড়ি জমান। জাহাঙ্গীর কবির নানক ও শেখ সেলিম ভারতে পালিয়েছেন। মির্জা আজমের অবস্থান এখনও জানা যায়নি। রাজনৈতিক নেতাদের বাইরে বিডিআরের তৎকালীন ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল শামসকেও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কুশীলব হিসেবে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। ঘটনার দিন পিলখানা সদর দপ্তরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন। বর্তমানে তিনি বিদেশে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডে সম্পর্কিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। পলাতক কুশীলবদের অবস্থান জানতে বেশ কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিচার এখনও শেষ হয়নি
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে কেবল হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
অন্যদিকে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরও ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন।
অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।
শহীদ পরিবারের ঠাঁই হয়নি সেই বাড়িতে
ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের ৬নং বাড়িতে থাকতেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০১০ সালে ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় তাকে। সেখানে নির্মাণ করা বহুতল ভবনে শহীদ পরিবারের ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলেছিল তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু সেখানে ঠাঁই হয়নি শহীদ পরিবারের।
এদিকে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর উপলক্ষে আজ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ পালিত হবে। গত রবিবার সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।