বাংলাদেশে প্রচলিত এনার্জি ড্রিঙ্কসে ক্যাফেইনের মাত্রা অত্যধিক বেশি পাওয়া গেছে, যা দেশের অন্যান্য কোমল পানীয়ের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) শর্ত অনুসারে, ‘ফিজি ড্রিঙ্কসে’ (কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশ্রিত কোমল পানীয়) ক্যাফেইনের সর্বাধিক মাত্রার অনুমোদিত সীমা হলো ১৪৫ পিপিএম (পাট পার মিলিয়ন)। যদিও এনার্জি ড্রিঙ্কসে ৩২১ দশমিক ৭ পিপিএম ক্যাফেইন পাওয়া গেছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ক্যাফেইনের অতিরিক্ত মাত্রা শরীরে মাদকতা সৃষ্টি করে, যা অনিদ্রা, ¯œায়বিক দুর্বলতা, এমনকি মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তাই সবার এসব পানীয় বর্জন করা উচিত। এ ছাড়া সরকারিভাবে এসব ক্ষতিকর পানীয় নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
মূলত ঢাকা শহরে পাওয়া সর্বোচ্চ বিক্রীত পানীয়গুলোতে জনস্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি মূল্যায়ন করতে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণার সুপারভাইজার ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান। এ ছাড়া প্রধান তদন্তকারী ছিলেন ডা. এএইচএম গোলাম কিবরিয়া।
এনার্জি ড্রিঙ্কসে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইনের বিষয়ে ডা. খালেকুজ্জামান বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ক্যাফেইন শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে। তাই এনার্জি ড্রিঙ্কস পানের ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যতটুকু ‘ক্যাফেইন’ মানুষ গ্রহণ করে, তার অর্ধেকটার প্রভাব শেষ হতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। আর তা পুরোপুরি শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে প্রায় পুরো একটা দিন সময় লাগে। যখন ‘ক্যাফেইন’ শরীরে বাড়াবাড়ি মাত্রায় পৌঁছায়, তখন রক্তচাপ বেড়ে যায়। এ কারণে সৃষ্টি হয় মানসিক অস্থিরতা, অস্বস্তি, শরীর কাঁপে, হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। যেহেতু ‘ক্যাফেইন’ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে গতিশীল করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে শরীরে ‘অ্যাড্রেনালিন’ হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এ কারণে মানসিক ও শারীরিক অস্থিরতা তৈরি হয়, মনে আতঙ্কও কাজ করে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর ‘ক্যাফেইন’য়ের প্রভাবের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ঘুম কমে। অতিরিক্ত ‘ক্যাফেইন’ ঘুম আসতে বাধা দেয়, আবার ঘুমিয়ে পড়লেও তা গভীর হয় না, সামান্য কারণে ভেঙে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালকোহল অ্যান্ড ড্রাগ ফাউন্ডেশন বলছে, ক্যাফেইন একটি ‘স্টিমুলেন্ট ড্রাগ’। এটি মূলত মস্তিষ্ক থেকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংকেতের আদান-প্রদানের গতি বাড়িয়ে দেয়। ‘ওয়েল অ্যান্ড গুড’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও উল্লেখ করা হয়, ক্যাফেইন সেই কাজটি সম্পাদন করে মূলত ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম’ বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং পেশিতে কর্মশক্তি বা ‘এনার্জি’ উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
এ ছাড়া কফি এবং এর ‘ক্যাফেইন’ অম্লীয়, আর তাতে থাকে ‘ল্যাক্সাটিভ’ বৈশিষ্ট্য। ফলে কফি অন্ত্রের ওপরেও জোরদার প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত কফি পানের কারণে হতে পারে বুক জ্বালাপোড়া, পেট ব্যথা, বদহজম, বমিভাব এবং ডায়রিয়া। মৃদুুমন্দ ‘ডাই-ইউরেটিক’ বৈশিষ্ট্য থাকায় অতিরিক্ত ‘ক্যাফেইন’ পানিশূন্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম। পরিমাণ মতো কফি যেমন সাধারণ মাথাব্যথা দূর করতে পারে, অতিরিক্ত কফি ঠিক সেটারই কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত কফি পান করাকে অভ্যাসে পরিণত করলে মাথাব্যথাও হয়ে যেতে পারে নিত্যসঙ্গী।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডক্টর অব ডিজিজ প্রিভেনশন’-এর ডা. এরিকা সোয়ার্জ বলেন, ‘কফি, চা, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিঙ্কস, চকোলেট ইত্যাদিতে ক্যাফেইনের দেখা মেলে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত এই উপাদান একজনের মনকে প্রফুল্ল করে, কর্মশক্তি বাড়ায়, শরীরের আলসেমি দূর করে। মাত্রা সহ্যসীমার বাইরে গেলে শরীরই জানান দেয়।’
গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে ফিজি ড্রিঙ্কস (সফট ড্রিঙ্কস ও এনার্জি ড্রিঙ্কস) চালু হয়। এরপর এটি শহর ও গ্রামে সর্বত্রই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে। কোমল পানীয় বা এনার্জিং ড্রিঙ্কসে পিএইচ, চিনি, ক্যাফেইন ও ভারী ধাতু থাকে। এগুলো অসংক্রামক রোগ বাড়ায়।
এখানে বিভিন্ন ধরনের পানীয় বিশেষ করে কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিঙ্কসের বোতল গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত সেরা দশটি কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিঙ্কস এই গবেষণার নমুনা হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন বাজার থেকে কেনা হয়। বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলে (বিসিএসআইআর) নমুনা পাঠানো হয়।
বিসিএসআইআর থেকে প্রাপ্ত ফলে দেখা গেছে, প্রায় ৩ থেকে ৪ ফিজি পানীয়তে ক্ষতিকর অ্যাসিডিক পিএইচ স্তর (<৩) ছিল। পিএইচ-এর মাত্রা (<৩) দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি কোমল পানীয়ের বোতলে (২৫০ মিলি) মোট চিনির পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৮ থেকে ২৮ দশমিক ৮ গ্রাম। এ ছাড়া এনার্জি ড্রিঙ্কসে এক বোতলে চিনির পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৬ থেকে -৩৭ গ্রাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দিনে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম চিনি খেতে পারেন। অথচ বেশির ভাগ সময় এক বোতল ফিজি পানীয় পান করলে একজন ব্যক্তির দৈনিক চিনির সর্বোচ্চ চাহিদা বা অনুমোদিত সীমা পূরণ হয়। একটি কোমল পানীয় (২৫০ মিলি) এবং এনার্জি ড্রিঙ্কসের বোতলে সিসার মাত্রা ছিল যথাক্রমে ০.০৫৩ ও ০.০৪৮।
গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, এসব পানীয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কঠোর পর্যবেক্ষণ করে স্বাস্থ্যের ওপর ফিজি পানীয়ের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।