সাবিত আর রাখি দম্পতির সঙ্গে আলাপ একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে। কথা বলে জানা গেল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন রাখি। প্রেগন্যান্সিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছেন, পুনরায় চাকরিতে যোগদান করে সহকর্মীসহ বাকিদের সহায়তাও পেয়েছেন, কিন্তু তার পরও এখন তিনি পুরোপুরি গৃহিণী। একান্নবর্তী পরিবারের শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে সন্তান রেখে বাইরে অফিস যাওয়া পছন্দ করেননি। ‘সন্তানের চেয়ে কি ক্যারিয়ার বড়?’Ñ এ কথার তোড়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি। সাবিত জানালেন, স্ত্রীর চাকরি করা নিয়ে তার আপত্তি নেই, কিন্তু বয়স্ক বাবা-মা বুঝতে চাননি। আত্মীয়স্বজনও একই কথা বলছে। গৃহশান্তির কথা ভেবে তাই রাখি চাকরি না করাকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সন্তান যদিও নারীর একার নয়, তার পরও সন্তানের জন্য নারীকেই সবচেয়ে বেশি ছাড় দিতে হয় আমাদের দেশে। সন্তান বাবা-মায়ের জন্য বিশাল দায়িত্ব, আনন্দ ও সম্পর্কের নতুন নাম। তবে এ দেশে অনেক সময়ই সন্তান আসে চারপাশের মানুষের কথা থেকে বাঁচতে, শ্বশুর-শাশুড়ির শখ পূরণ করতে, অসম বিয়ে টেকাতে কিংবা কোনো পরিকল্পনাহীন অবস্থায়। খুব কম পরিবারই পুরোপুরি দায়িত্বের কথা ভেবে, পরিকল্পনা করে সন্তান নেওয়ার কথা চিন্তা করে।
সন্তান আসে দুজনের সম্পর্ক থেকে, অথচ এ দেশে সন্তান ধারণ থেকে সন্তানের বাকি জীবনের দায়দায়িত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের ওপরই বর্তায়। কেন? গবেষণা বলে, মাদারহুড তথা মাতৃত্বের মূলত দুটি পার্ট। বায়োলজিক্যাল মাদারহুড এবং সোশ্যাল মাদারহুড। বায়োলজিক্যাল মাদারহুড এতটাই বেসিক ব্যাপার যে চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু সামাজিক মাদারহুড ব্যাপারটা বায়োলজিক্যাল মাদারহুডের ওপর বেইস করে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে। এটি যে শুধু চাকরিজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে হচ্ছে বিষয়টি তা নয়, একজন গৃহিণী এবং সদ্য মা হয়ে ওঠা নারীর কাছেও প্রত্যাশা থাকছে, তিনি একা আগের মতো ঘরের কাজ তো সামলাবেনই, সঙ্গে সন্তানের দায়িত্বও। এ সমাজে অনেকেই ঘরের কাজগুলো হিসাবে ধরেন না। জেন্ডার শ্রম বিভাজনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কাজের সুষম বণ্টনের সংস্কৃতি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এখনও গড়ে ওঠেনি। তাই সমাজ নির্ধারণ করে দেয় যে, সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রে মাকেই সব সময় শিশুর সঙ্গে থাকতে হবে। আর এ জন্যই নারীকেই চাকরি ছাড়তে হয়। ঘরে থাকলেও যেতে হয় প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে।
আরও একটি অসুবিধা হলো অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই ডে- কেয়ার সেন্টার নেই। ফলে নারীরা চাইলেও শিশুকে তাদের কর্মস্থলে নিয়ে যেতে পারেন না। তা ছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে বের হয়েও মায়েরা না ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হন; যেমনÑ অধিকাংশ জায়গায় বেবি ফিডিং কিংবা বাচ্চাদের ডায়পার পাল্টানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া দরকার। এত সব অসুবিধার মাঝেও কেউ কেউ আছেন যারা অফিস, সন্তান, সংসারÑ সবকিছু সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। পাপন-তিন্নি দম্পতি তাদেরই একটি উদাহরণ। দুজনই পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি তাদের ঘর আলো করে কন্যাসন্তান এসেছে। তাদের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল, সিঙ্গেল ফ্যামিলি হয়েও কীভাবে সবকিছু মেইনটেন করছেন? তিন্নি জানালেন, দুজনেরই শিফটিং ডিউটি থাকায় দিনের সময় ভাগ করে তারা অফিস করেন। একজনের অফিসের সময় অন্যজন সন্তানের সব দায়িত্ব পালন করেন। অস্থায়ী গৃহকর্মী সুবিধাজনক সময়ে এসে ক্লিনিংয়ের কাজ করে যান। তিন্নির মা নেই, শ্বশুরবাড়ির কারও পক্ষে এসেও থাকা সম্ভব নয়। তাই নিজেরাই একজন আরেকজনের সাহয্যকারী হিসেবে কাজ করছেন, দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে সংসার ও পেশা দুটিই ঠিক রাখছেন। এ ক্ষেত্রে দুজনের অফিসও যথেষ্ট সাপোর্টিভ আচরণ করছে। পাপন জানালেন, সংসারের সব কাজ ভাগ করে করছেন বলে সমস্যা হচ্ছে না। শিশুর দেখাশোনার সব কাজও তিনি শিখে নিয়েছেন। ফলে মায়ের অনুপস্থিতির সময়েও মেয়ের সমস্যা হচ্ছে না। সন্তান প্রতিপালন বাবা-মা দুজনেরই দায়িত্ব। প্রতিটি মা-ই সন্তানের এই দায়িত্ব খুবই উপভোগ করেন। কিন্তু সেই দায়িত্ব যখন একা মায়ের ওপর চলে আসে তখন সেটাই একসময় মায়েদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সন্তান যখন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, বাইরে নিজের জগৎ তৈরি হয়, তখন ক্যারিয়ার বিসর্জন দেওয়া মায়ের আর কিছু করার থাকে না। বয়স না থাকার কারণে তখন নতুন করে ক্যারিয়ার শুরু করারও সুযোগ থাকে না। তাই এই সময়ে একটু সহযোগিতাই একটা মাকে পারে তার হতাশা থেকে ফিরিয়ে এনে মাতৃত্বকে উপভোগ করতে।