রবিবার, ০৬:৪০ অপরাহ্ন, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫
  • ৪ বার পঠিত

বাংলাদেশের তরফে সর্বোচ্চ ছাড়ের মানসিকতা ছিল, ছিল সমঝোতার আশাবাদ। এর পরও সফলতা আসেনি। কোনো প্রকার সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন আলোচনা। বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় যখন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি কৌশলগত বোঝাপড়ার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, তখন একাধিক দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এ শুল্ক এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির ভারসাম্যেই বড় এক ধাক্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এ কঠিন সময়েও বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি ও কঠোর দর-কষাকষির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে কয়েকটি দেশ। চীন, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনাম কৌশলী আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের ওপর ধার্য করা অতিরিক্ত শুল্কহার কমিয়ে এনেছে। ভারতও একটি সমঝোতা চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর এখানেই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দুই দফায় ম্যারাথন আলোচনার পরও কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি ঢাকা। ফলে ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কের শঙ্কা ঘনিয়ে এসেছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পের ওপর।

ট্রাম্প প্রশাসন সর্বাধিক শুল্ক আরোপ করে চীনের ওপর, ৫০ শতাংশ।

পরে দর-কষাকষির মাধ্যমে তা কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। চীনের সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, যার আওতায় পারস্পরিক নিয়মনীতি এবং মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে বাজারে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যা দেশটি দর-কষাকষির মাধ্যমে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে আলোচনার মাধ্যমে সেটি কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হয়েছে। পাশাপাশি ভিয়েতনাম শুল্ক-ফাঁকি প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারতের ওপর প্রাথমিকভাবে ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। তাদের সঙ্গে ‘জিরো-ফর-জিরো’ বাণিজ্যনীতির আলোকে চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ভারতের জন্য শুল্কহার ২০ শতাংশের বেশি হবে না। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে ২৫ এবং জাপান ও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। তিনটি দেশই বর্তমানে সমঝোতার পথে রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্কের সঙ্গে এখনও আলোচনা চলছে। অবশ্য এখনও চুক্তি হয়নি। এ পর্যন্ত চীন, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনাম এই তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যাত্রা শুরু হওয়ার পর বাণিজ্য ঘাটতির অভিযোগ তুলে নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়। গত জুলাই মাসেই অন্তত ১৪টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ বা পুনঃআরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। অথচ পোশাক খাত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক, যা আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি।

এই সংকটকালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ব্র্যান্ড ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১০ লাখ পোশাকের অর্ডার স্থগিত করেছে। ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের মতো বড় কোম্পানিগুলো বসন্ত মৌসুমের সব অর্ডার স্থগিত করেছে বলে জানা গেছে। এর ফলে ছোট ও মাঝারি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ৯ থেকে ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক আলোচনায় অংশ নেয়। তবে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী এ আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ‘রুলস অব অরিজিন’ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পোশাকে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের দাবি জানিয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার পায়। তবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত অন্য দেশের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ শর্ত পূরণ কঠিন হয়ে পড়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১ আগস্টের আগে যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তবে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাক খাত চরম ঝুঁকিতে পড়বে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা হারাবে, অর্ডার বাতিলের ঘটনা বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হবে। এতে ছোট-বড় কারখানা বন্ধ হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দর-কষাকষিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রতিনিধি না থাকায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, প্রয়োজনে একজন দক্ষ লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ট্রাম্প সরকারের বাড়তি শুল্ক আরোপের পর আমাদের রপ্তানি ও মূল্যস্ফীতির ওপর কতটা প্রভাব পড়বে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমাদের তুলনায় প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্ক কম হলে আমাদের কাছে অর্ডার কম আসবে। এসব অর্ডার সেসব দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তিনি বলেন, সার্বিক ফল কি হবে, তা এখনও বোঝা মুশকিল। তবে আমাদের ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অথবা যাদের লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের কেউ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। যার ফলে তারা লবিং করতে পারেননি। ভিয়েতনাম ঠিকই তাদের মতো করে আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি। তার মানেই হচ্ছে, আমাদের কূটনৈতিক অবহেলা বা বড় ব্যর্থতা।

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, আরেকটি হচ্ছে- ভূ-রাজনৈতিক বিষয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যাদের ওপর নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, অন্যরাও একই মনোভাব পোষণ করে। তা হলে এখানে কথা থেকে যায়- ভিয়েতনাম কীভাবে পারল? ওরা কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ম্যানেজ করল? আমরা পারলাম না কেন?

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর জেষ্ঠ সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান (বাবলু) আমাদের সময়কে বলেন, ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভেবেছিলাম ১১ জুলাইয়ের মধ্যে একটা সমাধান হবে। আমরা এখনও আশাবাদী। আমরা মনে করি ৩৫ শতাংশ থেকে কমে হয়তো ২০-২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। ২০ শতাংশ হলে আমরা কিছুটা হলেও চলতে পারব। কিন্তু ৩৫ শতাংশই থেকে গেলে আমাদের জন্য টিকে থাকা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারে ভালো রপ্তানি করছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। নতুন নতুন বাজার খুঁজে রপ্তানি বাড়াতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বাদ দিয়ে নয়। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার টিকিয়ে রাখার।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ভারত, চীন, পাকিস্তানকে বিশেষ সুবিধা দিলে আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর হবে। বাংলাদেশ কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারবে না। ক্রেতারা ওসব দেশে চলে যাবেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com