প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাজানো যুদ্ধাপরাধ মামলার ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশনে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে প্রাণভিক্ষা চাইতে অস্বীকার করে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে বলেছিলেন মীর কাসেম আলী। বিশিষ্ট উদ্যোক্তা সংগঠক বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেমকে ফাঁসি কার্যকর করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই তার সেই আবেদন তখনকার রাষ্ট্রপতি কোনো বিবেচনায় না নিয়েই নাকচ করে দিয়েছিলেন। এর পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ তার ফাঁসি কার্যকর করতে ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করে।
এদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এর কনডেম সেলে থাকার সময় মীর কাসেম আলী বারবার কারা কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে বলেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনা সরকারের জুলুমের শিকার হয়েছেন। তিনি যুদ্ধাপরাধ মামলার অভিযোগের সাথে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। তাকে সাজানো মামলা দিয়ে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। কারণ ওই সময় (স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়) তার বয়স কম ছিল।
কারাগার সংশ্লিষ্টরা এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়ে আরো বলছেন, কনডেম সেলে মীর কাসেম আলী যতদিন ছিলেন বেশির ভাগ সময় তার কেটেছে কষ্টের মধ্যে। বিশেষ করে থাকার কষ্ট। তার মধ্যেও তিনি হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতেন। নামাজ, রোজা, আদায় করতেন নিয়মিত। এর মধ্যেও তিনি কারারক্ষী, কারাবন্দী ও তাদের স্বজনদের স্বল্প খরচে তার গড়ে তোলা স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠিয়ে চিকিৎসাসেবা দেয়ার ব্যবস্থা করাসহ মানবসেবা করে গেছেন তিনি।
কারা কর্মকর্তারা জানান, বন্দী অবস্থায় ওই কারাগারে একদিন কারাবন্দীদের নিয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী)। তিনি তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। তার ফাঁসির রায় দেয়া প্রসঙ্গে একটি মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন, মামলার মেরিট এবং তার সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় দেখা যায়, ওই সময় মীর কাসেম আলীর বয়স কম ছিল। কেন যে তাকে এই মামলায় জড়ানো হলো তা বলে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন বলে কারাগার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এ রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। ঢাকায় না নিয়ে এখানে তার ফাঁসি কার্যকর করার জন্য তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছিল। দেশের মানুষের মধ্যে অনেকেই তার এই ফাঁসি দেয়াকে শেখ হাসিনা সরকারের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের গড়ে তোলা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তখন।
কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর কনডেম সেলের দিনগুলো
একদিন বিকেলে কারাগার থেকে মীর কাসেম আলী তার এক ঘনিষ্ঠ মানুষকে টেলিফোন করে বলেন, তোমরা সবাই কেমন আছো। আমার জন্য তোমরা দোয়া করো। পাশাপাশি ওকে বলো (ম অদ্যাক্ষর) কিছু একটা করো। কারাগারের লোকজন আমার সাথে একটু ঝামেলা করছে। আমি এখানে এখন অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। আমি যেখানে আছি সেখানে নেই কোনো জানালা। ছোট্ট একটি ঘর। এখানে আমাকে আটকে রেখেছে ওরা। আমি গরমে ঘেমে যাচ্ছি। আমার যা হওয়ার হবে। ফাঁসি দেবে দিক। তার আগে আমাকে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারো কি-না তোমরা দেখো। সরকার তো আমাকে টার্গেট করে কষ্ট দিচ্ছে। উপরের কঠোর নির্দেশনা থাকায় কারা কর্তৃপক্ষও সুযোগ দিতে পারছে না। ফাঁসি হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ওই কনডেম সেলের মধ্যে শেষ সময়টুকু পার করতে হয়েছিল। ফাঁসি হওয়ার এক সপ্তাহ আগে মীর কাসেম আলীর সাথে তার ছেলে ব্যারিস্টার আরমান সাক্ষাৎ করেন। এরপরই তিনি গুমের শিকার হন।
আমার ‘অপরাধের’ দায় ছেলের ওপর কেন?
মীর কাসেম আলীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে স্বজন ও সহকর্মীদের কাছে জানতে পারেন তার ছেলে গুম হয়েছে। এরপর তিনি স্বজনদের বলেছিলেন, আমার ‘অপরাধের’ দায় আমার ছেলের ওপর কেন? তোমরা সরকারের ওপর মহলের সাথে কথা বলো। আমার নিরপরাধ ছেলেটাকে তাদের ছেড়ে দিতে বলো। তাকে কেন গুম করল তারা।
এনএসআইয়ের সাবেক ডিজির প্রতারণা!
দীর্ঘ কারাজীবন শেষ করে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন এমন একজন আলোচিত ব্যক্তির কাছে মীর কাসেম আলীর কারাজীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার দেখা মতে কারাগারে যে কয়জন জামায়াতে ইসলামীর নেতা আছেন তাদের প্রত্যেকেই সৎ ব্যক্তি। তাদের জীবনযাপনও স্বাভাবিক। এরপর তিনি হেসে বলেন, আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেবো। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কনডেম সেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মীর কাসেম আলী ভাইয়ের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো এবং কথা হতো। আড্ডা হতো। একদিন আমি মীর কাসেম আলী ভাইকে হেসে জানতে চাইলাম, ভাই আপনি কী কারণে বাংলাদেশে ফিরে আসতে গেলেন। না আসলেই তো পারতেন। তখন তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় আমাকে বলেছিলেন, আমি দেশে আসব না কেন? আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আমার নামে যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে এসবের সাথে আমার মোটেও সম্পৃক্ততা নেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসব। এরই মধ্যে সরকারের এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বললেন, আপনি দ্রুত দেশে ফিরে আসেন। আপনার আর কোনো সমস্যা হবে না। তার কথায় মনো হলো এ লোক তার সাথে প্রতারণা করেছিলেন।
কারাগারের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি তুলে ধরে ওই ব্যক্তি নয়া দিগন্তকে শুধু বলেন, মীর কাসেম আলী ভাই, মতিউর রহমান নিজামী ভাই, কাদের মোল্লা ভাই, কামরুজ্জামান ভাইদের সাথে আমার জেলজীবনের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। সময় হলে সবই বলব। এখন কিছুই বলব না।
মীর কাসেম আলী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, কাসেম ভাই খুব ভালো মানুষ, মজার মানুষ। আমিও তাকে ঠাট্টা করে বলতাম, আপনি শুধু তেলাপিয়া মাছ দিয়ে ভাত খান কেন। আসলে কাসেম আলী ভাইয়ের চাহিদা ছিল না। যখন ফাঁসি দেয়ার সময় হয়েছিল তার আগেই কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে গাজীপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় হওয়ার ব্যাপারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের ইন্ধন ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি এই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, থাক আরেক দিন এ নিয়ে কথা বলব।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যা বলেছিলেন
মীর কাসেম আলী কখনো রাজনৈতিক বিষয়ে আপনাদের কাছে কোনো কথা বলেছিলেন কি-না জানতে চাইলে দায়িত্বশীল এক কারা কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, না না না উনি জুলুমের শিকার হতেন এটাতো বলতোই। বাট স্পেসিফিক ইয়ে মানে কিছু বলতেন না। জুলুমের শিকারে কী বলতেন, জানতে চাইলে বলেন, সার্বিকভাবে তার (মীর কাসেম আলী) বিরুদ্ধে যে রায়টা হইছে, যেহেতু সে ব্যক্তিগতভাবে এটার মধ্যে জড়িত না, তার বয়স কম ছিল।
কারা কর্মকর্তা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই সময় এস কে সিনহা কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ ভিজিট করেছিলেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে প্রথম কারাগার ভিজিট করেছিলেন আমাদের সময়ে। তার আগমন উপলক্ষে আটক বন্দীদের জামিনের ব্যবস্থা করানোসহ তিনটি বিষয়ের সমস্যার সমাধান করিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। এস কে সিনহা অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন কারা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে কথা বলতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সাহেব মীর কাসেম আলী সাহেবের ফাঁসির রায় দেয়া নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যাদের জড়িত করা হয়েছে তাদের অনেকের কিন্তু বয়সই ছিল না। মীর কাসেম আলীর তো বয়স কম ছিল। উনার সাথে দেখা করে কি এসব কথা বলেছিলেন। এ প্রশ্নের জবাবে কারা কর্মকর্তা বলেন, না না কারাগারের কনফারেন্স রুমে যখন ব্রিফিং করা হচ্ছিল তখন অনেক মিডিয়ার সামনেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এই কথাগুলো বলেছিলেন। মূলত এস কে সিনহা মীর কাসেম আলীকে মেনশন করে বলেছিলেন, আমি একটা বই পড়ে দেখলাম, তার তো আসলে বয়সই হয়নি যুদ্ধাপরাধী হওয়ার মতো। মীর কাসেম আলীকে উদ্দেশ করে তিনি এ কথা বলেছিলেন ফাঁসি হওয়ার কয়েক মাস আগে। আর উনি যে জুলুমের শিকার হয়েছেন এটা তিনি মাঝে মধ্যেই বলতেন।
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি
তিনি যে এই মামলাটায় জড়িত না, তার বয়স কম ছিল এবং বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে তাতে তার ওপর জুলুম করা হচ্ছে। তাই তিনি সবকিছুর ফয়সালা আল্লাহ্র ওপরই ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। আর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে কিন্তু ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে মোটেও রাজি ছিলেন না। যেহেতু ওই গভর্নমেন্টই তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিতে যাচ্ছে, তাই ওই গভর্নমেন্টের রাষ্ট্রপতির কাছে তার ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার পক্ষে কোনো আগ্রহই ছিল না।
পরবর্তীতে আমরা তাকে বুঝিয়েছি, আপনি এই প্রসেসিংয়ে আদালতের মাধ্যমে তো আর এখান থেকে বের হতে পারবেন না। আপনার লাস্ট ধাপ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়া তো আর কোনো কথা বলার পথ নেই। পরবর্তীতে কথাটা চিন্তা ভাবনা করে একদিন পর বললেন, না তোমাদের কথাটা যৌক্তিক মনে হলো, আমার কথাটা আমি বলতে পারি। কিন্তু উনি তাতে তার ‘অপরাধ’ স্বীকার করে বলেননি, আমি যুদ্ধাপরাধ করেছি।
তিনি বলেছেন যে, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য নয়, এটা থেকে অব্যাহতি চাই। ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে মানুষ ক্ষমা চাইলে দোষ স্বীকার করে তারপর প্রাণভিক্ষা চায়। উনি সেটি করেননি। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনে তিনি কী লিখেছিলেন জানতে চাইলে কারা কর্মকর্তা বলেন, উনি তো তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে এ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন। এর রেকর্ড কপি সরকারের কাছে রয়েছে।
আমার তো কিছু নাই, মিডিয়া ধনাঢ্য বানিয়েছে
একাধিক কারা কর্মকর্তা ও কিছু সেবক নয়া দিগন্তকে বলেন, কারাগারে আসার পর আমি যতটুকু দেখলাম মীর কাসেম আলী সাহেব জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করলেও উনি কিন্তু একজন মডার্ন মুসলিম ছিলেন। উনার পোশাক আশাকে যেমন আধুনিকতা ছিল তেমনি নীতি আদর্শেও তিনি ছিলেন অটল। উনার মুখে ছিল রসিকতা, আড্ডা দেয়া, জোকস করা- এসবের মাধ্যমে মোটকথা সব সময় জমিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন তিনি।
তিনি বলেন, মীর কাসেম আলী সাহেব আমাকে বলতেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষের কাছে, মিডিয়ার মাধ্যমে সরকার এমনভাবে প্রচার করত, যেন তিনি অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি, প্রচুর ক্ষমতা উনার। উনি টাকা দিয়ে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা কি তা তো তোমরা জানো।
এক কারা কর্মকর্তা বলেন, আমার সাথে কিন্তু তার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নাই। আমার সাথে তার বিষয়ে যেসব কথা হয়েছিল সেগুলোই আমি বলছি। কোনো কথা বাড়িয়ে বলছি না।
উনার কাছ থেকে আমি বয়সে ছোট হওয়ায় তিনি আমাকে তুমি করে বলতেন। বলতেন শোন, তোমাকে একটা কথা বলি, সবাই জানে আমি বিশ্বে একজন ধনী লোক। এই হিসেবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সবখানে। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থা কী, বর্তমানে আমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমি বাংলাদেশে ১০৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছি দেশের মানুষের অর্থনীতির উন্নয়নে, কর্মসংস্থানের জন্য। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, কেয়ারী সিন্দাবাদ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করেছি। এগুলো কোনোটাই কিন্তু আমার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান না। ইসলামী ব্যাংকে আমার ন্যূনতম একটা শেয়ার ছিল। পরবর্তীতে সেটাও এখন আমার নাই। যখন আমি ইসলামী ব্যাংকে দায়িত্ব পালন করতাম তখন ব্যাংক আমাকে গাড়ি ব্যবহার করতে দিয়েছিল। কত দিন, যতদিন আমি দায়িত্বে ছিলাম। ইবনে সিনায়ও আমি একটি পোস্ট হোল্ড করতাম। বৈধভাবে একটি গাড়ি দিয়েছিল। এরপর সেই গাড়িটি অফিসিয়ালি আমি ফেরত দিয়েছিলাম। আমি গাড়ি নিবো না, তারাও আমাকে দেবে না। কারণ ওটা ছিল অফিসিয়ালি গাড়ি। বর্তমানে আমার ফ্যামিলি আর্থিকভাবে খুবই স্ট্রাগল করছে। দামি গাড়ি বিক্রি করে ভাঙা গাড়ি কিনেছি। পুরনো ভাঙাচুরা একটি মাইক্রোবাসে চড়ে আমার পরিবার ও লোকজন কারাগারে আসে। মিরপুরে পুরনো একটা পৈতৃক বাড়ি আছে। সেখানে পরিবার থাকে। আমরা কোন ধরনের অবৈধ টাকা পয়সা লেনদেনের সাথে জড়িত না। আমার অবৈধ টাকা পয়সার কোনো মোহ নাই। আমার একটাই ইচ্ছা ছিল দেশের অর্থনীতির উন্নতি করা। আমার দর্শন ছিল যে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংও আছে, শরিয়াহ ব্যাংকিংও আছে, লিবারেল ব্যাংকিংও আছে। আমি যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর সাথে আছি তাই দেশে ইসলামী ভাবধারায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।
কারাগারে থেকেও দিয়ে গেছেন মানবসেবা
ওই কর্মকর্তা বলেন, মীর কাসেম আলী (উনি) কারাগারে আটক থেকেও আমাদের স্টাফদের অনেক ধরনের খেদমত করতেন। যাদের চিকিৎসার সমস্যা ছিল তাদের বিষয়ে তার হাসপাতালের স্টাফদের বলে দিতেন। তারা গিয়ে সেখানে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা করাতে পারতেন। উনি কারাগারে থেকেই জেলের স্টাফদের দিয়েছেন সেবা। সহজ শর্তে এসএমই লোন দেয়ার সুপারিশও করে দিয়েছেন। তারপর তার সই নিয়ে হাসপাতালে গেলে পেতেন চিকিৎসাসুবিধা। উনার মধ্যে ইসলামী শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও আধুনিকতার ভাব বেশি ছিল। শুধু তাই নয়, কারাগারে মীর কাসেম আলী ডেন্টাল ইউনিট তৈরি করে দিয়েছেন। বাইরে থেকে তিনি কার্টন কার্টন ওষুধ সাপ্লাই দিতেন।
মীর কাসেম আলী তার গ্রেফতারের বিষয়ে কিছু বলেছিলেন কি-না জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, অভিযোগের ঘটনার সময় তার বয়স অনেক কম ছিল। কত বয়স ছিল বলেছিলেন, ধরেন না উঠতি বয়সের যুবক ছিল। ’৭১ এ তার বয়স অনেক কম ছিল। উনি দেশে ফিরে এসেছিলেন কেনÑ এ ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে মীর কাসেম আলী তার এক বিশ্বস্ত কারারক্ষীকে বলেছিলেন, উনার একটা কনফিডেন্স ছিল দেশে ফিরে এলে হয়তো বা তার কিছুই হবে না। বানানো অভিযোগে যে ফাঁসির রায় হয়ে যাবে এটা তিনি কখনো কল্পনা করেননি। জেলের মধ্যে কনডেম সেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো উনার। তার বিষয়ে রাজনৈতিক চাপ ছিল বেশি। শেষ সময়ে আমি উনাকে দেখেছি, উনি সবসময় নামাজ রোজা ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি সময় কাটাতেন।
যেভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হয়
ডেটলাইন ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। এদিন রাত ১০টার পর যেকোনো সময় ফাঁসি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এর আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কিভাবে কার্যকর করা হবে তার মহড়া সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ।
এই লক্ষ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রধান জল্লাদ শাহজাহান ভূইয়াকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এ পাঠানো হয়। একদিকে মহড়া অন্যদিকে ফাঁসি কার্যকর করার আগে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কথা জানানো হয় মীর কাসেম আলীকে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দেয়া নির্দেশনা যায় আইজি প্রিজন্সের কাছে। পরে তার নির্দেশে মীর কাসেম আলীর কনডেম সেলে যান। তারা তাকে জানান, আপনার ফাঁসির রায় হয়ে গিয়েছে। এখন সর্বশেষ একটা সুযোগ আছে। আর সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আবেদন।
তখন মীর কাসেম আলী তাদের স্পষ্টভাবে বলেন, তার যা হওয়ার হবে। সবকিছুর ফয়সালা তিনি আল্লাহ তায়ালার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। তাদেরকে তিনি ফাঁসি কার্যকরের পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়ে দেন। কারা কর্মকর্তারা তার কথা শুনে সেল থেকে ফিরে যান।
পরের দিন আবারো তারা তার সেলে গিয়ে মার্সি পিটিশন করার আবেদন করতে বলেন। দু’দিন চিন্তাভাবনা শেষে তিনি কারা কর্তৃপক্ষের দেয়া আবেদনে নিজের হাতে যা লেখার লিখে দেন। ওই পিটিশন কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। সেটি পাঠানোর পরই রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ করেন। সন্ধ্যার পর পরিবার আত্মীয়স্বজনদের সাথে তার শেষ সাক্ষাৎ করানো হয়। পরিবারের সদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে ফিরে যান। এরপরই শুরু হয় ফাঁসির কার্যক্রম।
প্রত্যক্ষদর্শী কারা কর্মকর্তারা নয়া দিগন্তকে বলেন, ফাঁসির মঞ্চের দিকে যখন মীর কাসেম আলী এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি শুধু কলেমা পড়ছিলেন। এসময় সুনসান নীরবতার মধ্যে তিনি ছিলেন ধীরস্থির। এর আগে দেশবাসীর কাছে তিনি দোয়া চেয়ে একটি কথাই সবার উদ্দেশে বলে গেছেন, সবকিছুর ফয়সালা তিনি মহান আল্লাহ্ তায়ালার ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন। ফাঁসির আগে তার শেষ কথা ছিল, আল বিদায়, আবার দেখা হবে। জল্লাদ লিবার টানলে মানবসেবক মীর কাসেম আলীর দুনিয়ার পর্ব শেষ হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ তার লাশের গোসল করিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ওই গাড়িটি মানিকগঞ্জে তার নিজ গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। যাওয়ার সময় তার ব্যবহার্য কাপড়, জায়নামাজ, তসবিহসহ প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।
ব্যক্তি মীর কাসেম আলী
মীর কাসেম আলী (৩১ ডিসেম্বর ১৯৫২-৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬) ছিলেন বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
পিতা তৈয়ব আলী ও মাতা রাবেয়া বেগমের দ্বিতীয় সন্তান মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মীর কাশেম আলী প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বরিশালে অবস্থিত আদর্শ বিদ্যালয়ে ১৯৫৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা স্কুলে লেখাপড়া করে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করে ১৯৬৭ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৭-১৯৬৮ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে লেখাপড়া করে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষে বিএসসি অনার্স প্রথম বর্ষে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষের লেখাপড়া স্থগিত করেন। অতঃপর ১৯৭১-১৯৭২ শিক্ষাবর্ষের বিএ পাস কোর্সে সাবেক আদর্শ কলেজ বর্তমানে আইডিয়াল কলেজ, ৬৫ সেন্ট্রাল রোড ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে অধ্যয়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৩ সালের বিএ (পাস) পরীক্ষায় (১৯৭৪ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়) উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালের এমএ প্রিলিমিনারি এবং ১৯৭৫ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর/১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত) অর্জন করেন।
ব্যবসায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা
মীর কাসেম আলী ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন। তিনি দিগন্ত মিডিয়া গ্রুপেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ইবনে সিনা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৬২ সালে সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বিশ্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও দাতব্য সংগঠন ‘রাবেতা আল-আলম আল ইসলামী’ এর এদেশীয় পরিচালক ছিলেন। এসবের বাইরে তিনি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট অ্যান্ড বিজনেসম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, কেয়ারি লিমিটেড, ফুয়াদ আল খতিব, আল্লামা ইকবাল সংসদ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজি ও পিস স্টাডিসসহ দেশে-বিদেশে মোট ৪০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর পাকিস্তান ও তুরস্ক দুঃখ প্রকাশ করে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এখানে বিচারের নামে অবিচার সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ করেন।