অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া কমিশনগুলোর সব সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর বেশ কিছু প্রস্তাবকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে দলটি। দলটির অভিমত, কিছু অপ্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব সমাধানের চেয়ে জটিলতা আরও বাড়াবে। নতুন কোনো জটিলতা সৃষ্টির আগে সংস্কার কমিশনগুলোর অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাবগুলো চিহ্নিত করে শিগগির অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করতে চায় বিএনপি।
গত সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নীতিনির্ধারকরা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি বিএনপির তরফ থেকে। তবে পরের দিন গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংস্কারের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা খুব শিগগির এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ডাকবেন, একটা সমাধানের দিকে আসবেন, আলোচনা হবে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা একটা
জায়গায় পৌঁছাব।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানা যায়, বৈঠকে বেশ কয়েকটি এজেন্ডা থাকলেও মূলত দুটি এজেন্ডার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে সংস্কারের উদ্যোগ, অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র।
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর ৬ অক্টোবর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ৩ অক্টোবর অন্য পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সবগুলো কমিশনকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া সবগুলো কমিশনের মেয়াদ ২ জানুয়ারি শেষ হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের মেয়াদ শেষ হয় ৪ জানুয়ারি। এরপর ২ জানুয়ারি দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি এবং বাকি পাঁচ কমিশনের মেয়াদ ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গত ১৫ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধানরা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এক নেতা বলেন, সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের একটাই কথা, নির্বাচন-সংক্রান্ত ন্যূনতম সংস্কার কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব কাজ একসঙ্গে করলে কোনোটাই হবে না। সেক্ষেত্রে জটিলতা আরও বাড়বে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে।
বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেন, সময়ের চাহিদা ও বাস্তবতাকে মাথায় রেখে বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারে জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর অংশ হিসেবে ২০২২ সালে তারা ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছে। এই ৩১ দফাই হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে বড় দলিল। এমনকি এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পর কমিশনকে সহযোগিতা করতে তারা নিজেরাও দলীয়ভাবে ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী ধরনের সংস্কার আনা যেতে পারে, সেসব সুপারিশ তারা এরই মধ্যে কমিশনের কাছে তুলেও দিয়েছে।
বিএনপি আশা করছে, বিভিন্ন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার শিগগির একটি রাজনৈতিক সংলাপ আহ্বান করবে, যেখানে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত হবে।
এদিকে দেশের পুরনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছে সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেওয়ার পক্ষে এ কমিশন। এই চার প্রদেশ হলো- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। বিএনপি নেতাদের অভিমত, এটা অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব। বাংলাদেশে এটার কোনো বাস্তবতা নেই, বরং এটা নানান ধরনের জটিলতা বাড়াবে। এতে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। অঞ্চলভিত্তিক নানা জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান হতে পারে, যারা সেখানে নিজেদের টেরিটোরি ঘোষণা করতে পারে। যেগুলোর ওপর একটা পর্যায়ে হয়তো সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এই ধরনের উদাহরণ আছে। সুতরাং, এটা বিতর্ক আরও বাড়াবে এবং রাষ্ট্রের যে সার্বভৌম অস্তিত্ব, সেটাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। তাই এটার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে বিএনপি মনে করে না।
অন্যদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির সরকারি উদ্যোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট সরকার পতন হলেও এতদিন পর ঘোষণাপত্র তৈরি উদ্যোগ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মনে করছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এ মুহূর্তে এটার কোনো দরকার নেই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডাকে গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। ওই বৈঠকে ঘোষণাপত্র নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। সেখানে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান, গণ-আন্দোলনের রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এর আইনি ভিত্তি কী হবে, সে ব্যাপারেও যথেষ্ট আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এত সময় পরে এসে কেন এই উদ্যোগ, সর্বদলীয় বৈঠকে সেটাও তিনি জানতে চান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে একটি ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র ভিত্তিতে। এখন সাড়ে পাঁচ মাস পর তারা যে ঘোষণাপত্র দিতে চান, সেটি সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। এখন এটার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তারা মনে করেন না। যদি তারা (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) সেই সময় কোনো ডিক্লারেশন দিত, সেটি নিয়ে তখন হয়তো একটা রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি হতে পারত। কারণ, সবাই তখন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন চেয়েছিল।
বৈঠকে এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলেন, ফ্যাসিবাদের পতন হলেও দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এর বাইরেও দেশে বিতর্ক সৃষ্টির নানা চেষ্টা আছে। এর আগে সংবিধান বাতিল করার দাবি এসেছে। কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছে। এর পরই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে এটিও এক ধরনের বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।
এদিকে, বৈঠকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরনগঞ্জ সীমান্তে সংঘর্ষ, বিএসএফের গুলি, বাংলাদেশিকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা; দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া; সম্প্রতি মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত একটি গ্রাফিতি বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপরে চীন এবং অরুণাচলের সিয়াংয় নদীর উপর ভারতের বাঁধ নির্মাণের ‘উচ্চাভিলাসী’ প্রকল্প নিয়েও আলোচনা করেন বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। তাদের অভিমত, বাংলাদেশের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।