খাঁটি সরিষার তেল সবাই খুঁজলেও ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের খবর কেউ রাখে না। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর সেই ঘানি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে ঘানি জিনিসটি অপরিচিত। অথচ দুই দশক আগেও গ্রামবাংলায় ঘানি দেখা যেত। প্রক্রিয়াজাতকরণের এ পুরনো পদ্ধতি থেকে পাওয়া তেল মান ও বিশুদ্ধতার দিক থেকে সেরা ছিল। পেশাটি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি।
কাঠের তৈরি এ ঘানিকে দেশের কোনো কোনো এলাকায় গাছের তেল বা তেলের গাছ নামেও পরিচিত। এ পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কলু বা তেলি নামে পরিচিত। তবে ঘানিতে তেল ভাঙানোর প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ হওয়ায় আধুনিক মেশিনের সাথে প্রতিযোগিতায় হিমশিম খেতে খেতে এখন বিলুপ্তির পথে। বাধ্য হয়ে অনেকেই পরিবর্তন করছেন এ পেশা। তবে এখনো ভালোবেসে পূর্ব-পুরুষের এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন কেউ কেউ। দিনবদলের সাথে সাথে এখন কাঠের ঘানির পরিবর্তে প্রযুক্তির আশীর্বাদে লোহার ঘানিতে ভাঙা হচ্ছে সরিষার সাথে বিভিন্ন দ্রব্যাদি। ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে লোহার এ ঘানিগুলোতে কেবল সরিষা-ই নয় তিল, তিশিও ভাঙানো হচ্ছে। এতে কাঠের ঘানির চেয়ে উৎপাদন খরচও কম। তাই এ অসম প্রতিযোগিতার সাথে পাল্লা দিতে পারছে না কাঠের ঘানিতে উৎপাদিত খাঁটি সরিষার তেল।
আগেকার দিনে দিন-রাত গরু দিয়ে কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোঁটায় ফোঁটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেল গ্রামগঞ্জে মাটির হাড়িতে ফেরি করে এবং হাটবাজারে বিক্রি হতো। হাঁড়ির ঢাকনির নিচে থাকত তালের বিচির খোসা দিয়ে তৈরা করা বাঁশের হাতলের ওড়ং। তেল তুলে দেয়ার জন্য এ ওড়ং ব্যবহার করা হতো। এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করতেন ঘানি শিল্পের সাথে জড়িতরা। চাহিদা থাকলেও খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আর বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না তারা। আবার কোনো কোনো লোহার ঘানিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সরিষার সাথে চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, শুকনা মরিচসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত করে ভেজাল সরিষার তেল উৎপাদন করছেন। এভাবে কৃত্রিম তেল দখল করেছে সরিষার তেলের বাজার। কৃত্রিম তেল স্বল্প দামে বিক্রি করায় ঘানিতে দিন-রাত পরিশ্রম করে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদন করে স্বল্প দামে বিক্রি করতে পারছেন না উৎপাদনকারীরা। ফলে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না।
চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর গ্রামের বড়ভিটা, হাসিমপুর, আব্দুলপুর, জোত রামধনপুরসহ বিচ্ছিন্নভাবে এখনো ঘানিতে তেল উৎপাদন করছেন অনেকে। আবার অনেকে যুগের পরিবর্তনে আর পর্তা (সুবিধা) করতে না পারায় এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
উপজেলার নশরতপুর গ্রামের বড়ভিটা তেলীপাড়ার মোকছেদ আলী জানান, ‘এখন হাতেগোনা ঘানির সংখ্যা। ঘানি ভাঙা তেলের চাহিদার পরেও আধুনিক মেশিন নির্ভর শিল্প ও প্রযুক্তি প্রসারের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘানি শিল্প। ঘানিতে পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এভাবে দিনে একটি ঘানি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি সরিষা ভাঙা সম্ভব হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি তেল খুচরা বিক্রি হয় ৪০০ টাকা দরে। তবে কেমিক্যালসহ নানাভাবে উৎপাদিত সরিষার তেল বাজারে স্বল্প দামে বিক্রি করায় ঘানির খাঁটি সরিষার তেল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বেশি দামের কারণে অনেকে কেনেন না।’
উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের বিন্যাকুড়ি হাটে তেলি আজিজার রহমান জানান, ‘তার বাড়িতে তিনটি ঘানি বা তেলের গাছ রয়েছে। তার বাপ-দাদাও ছিলেন তেলি। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে এ পেশায় নেমেছেন।’
প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিতে না পারা, সরিষা ও গোখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তেলিরা। তবে এখনো অনেক ক্রেতা লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে কাঠের ঘানিতে তৈরি শতভাগ বিশুদ্ধ সরিষার তেল খুঁজে থাকেন। সেজন্য দুই-একজন তেলি তাদের পূর্ব-পুরুষদের পেশা ধরে রেখেছেন।