নয়াদিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে এবং দুই পক্ষ তাদের আগের অবস্থানেই আছে—এ খবরের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে। প্রথমত, বাংলাদেশের নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে দিল্লিতে আলোচনার প্রয়োজন পড়ল কেন? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের আগ্রহ–উৎসাহ কখন ও কীভাবে ‘হস্তক্ষেপে’ পরিণত হলো? তৃতীয়ত, বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দুই পর্বের আলোচনার প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ।
নয়াদিল্লিতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা এক অর্থে এটাই দেখায় যে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতে নেই, যা বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়। কিন্তু এ নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা উচ্চবাচ্য করেনি।
এর ফলে এই প্রশ্ন তোলার অবকাশ তৈরি হয় যে বাংলাদেশের সরকার কতটা স্বাধীন? (মাহ্ফুজ আনাম, ডেইলি স্টার বাংলা, ৬ অক্টোবর ২০২৩)। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আলোচনার পর দৃশ্যত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের মধ্যে একধরনের আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
এই মন্তব্য এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর প্রকাশিত বিবৃতিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে আগে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে দাবি করেছিলেন, ‘তলেতলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে, আমরা আছি।’ (ডেইলি স্টার বাংলা, ৩ অক্টোবর ২০২৩), তা সঠিক ছিল না। সম্ভবত ক্ষমতাসীনদের আশঙ্কা ছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে ভারত তার অবস্থান বদলে ফেলবে।
এ ধরনের কথাবার্তার কারণ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে এক অসম সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা, যে পর্বের সূচনা হয়েছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই। এ ধরনের মন্তব্যের আগে গত বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি যে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার, সে জন্য ভারতবর্ষ সরকারকে আমি সেই অনুরোধ করেছি।’ (বিবিসি বাংলা, ১৯ আগস্ট ২০২২)।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেখা গেছে যে রাজনৈতিক দলগুলোকেই কেবল নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য ক্ষমতাসীনেরা সফল হয়েছে তা নয়, যেকোনো নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অংশীদার যে ভোটার, তাঁদেরও বাইরে রাখা হয়েছে। এর ফলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে ২০২৪ সালে নির্বাচন হলেই তাতে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন, সেটার সম্ভাবনা নেই। তার জন্য দরকার নির্বাচনকালীন এমন একধরনের ব্যবস্থা, যা ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্য, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে পারে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা এই দাবি উপেক্ষা করে যে কথা বলছেন, তা হচ্ছে তাঁদের অধীনেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হতে হবে। তা যে অসম্ভব, তার অসংখ্য উদাহরণ আছে। সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত দুটি উপনির্বাচনেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন এসব ব্যর্থতার দায় না নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছে ‘যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করতে হবে’ (কালবেলা, ১০ নভেম্বর ২০২৩)
অতীতে নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীনেরা ‘নির্বাচনের মূল্য’ হিসেবে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারকেই জলাঞ্জলি দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ করে ভেঙে দেওয়া, বিএনপি নেতা-কর্মীদের বেশুমার আটক-মামলা-নিপীড়ন এবং ক্রমাগত সহিংসতাকেই ‘যেকোনো মূল্য’ বলে বিবেচনা করে এবং তাকেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মনে করে, কেবল তবেই বলা সম্ভব যে যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করতে হবে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই আলোচনায় ভারতের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? কেউ কেউ সেই প্রশ্ন করতে পারেন। ২০০৯ সাল থেকে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এ ধরনের নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থাই হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র। যদিও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের মানুষ তাঁদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এ ধরনের বক্তব্যের সময় তাঁরা ভারতের জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে সামনে আনলেও এ কথা বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই, গত ৯ বছরে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে চেয়ে পায়নি, এমন কিছুই নেই। এই অসম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা জনগণের ম্যান্ডেটের ওপরে নির্ভর করেনি। অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি উপস্থিত থাকলে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার যেসব সুবিধাদি ভারত পেয়েছে, তার একটি বড় অংশের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকত।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত এখনো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চেয়ে, অবাধ নির্বাচনের চেয়ে এমন সরকার আশা করে, যার ম্যান্ডেট প্রশ্নবিদ্ধ থাকার কারণে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক নির্ভরতা ভারতের ওপরেই থাকবে। এই নির্ভরতা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি বড় অংশই মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থন হ্রাস পেলে ক্ষমতাসীনদের আচরণে পরিবর্তন ঘটবে। এই ধারণার বিষয়ে ক্ষমতাসীনেরা অবহিত। যে কারণে ওবায়দুল কাদের নির্দ্বিধায় বলেন, ‘দিল্লি আছে, আমরাও আছি’; বলেন, ‘চিন্তার কিছু নেই’।
বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে ব্যবহার করে বিকাশমান ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলোর অর্থনীতি, ওই অঞ্চলের ভূকৌশল এবং নিরাপত্তাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হওয়া। লক্ষণীয় যে ভারত তার পররাষ্ট্র এবং নিরাপত্তানীতিসমূহ সেভাবেই সাজিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নির্ভরতা ভারতের ওপরে থাকুক।
দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এর বিপরীতে; গত দেড়–দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া বার্তা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকার দেশের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করুক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরা কর্তৃত্ববাদী আদর্শের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেবেন, যার প্রতিফলন কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই পড়বে, তা নয়, পররাষ্ট্রনীতিতেও পড়বে।
নয়াদিল্লিতে যে আলোচনা, তা প্রতিপক্ষের মধ্যকার আলোচনা নয়; ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতিম দেশ। কিন্তু আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিবেচনায় দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে এই আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেখানে ভারত তার অবস্থান বলেছে; যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে একমত হয়েছে, এমন লক্ষণ নেই। তার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের পথগুলো এতটাই সরু এবং অমসৃণ করে ফেলা হয়েছে এবং তার পেছনে ভারতের সমর্থন ও স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে, সেই বিষয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ অনুপস্থিত, বিদেশিরাই পথরেখা ঠিক করছে।
আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব: বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ কেন, সামনে কী