ইসলাম মানুষের কাছে হালাল-হারাম দু’টি পদ্ধতির স্পষ্ট বিধিবিধান বাতলে দিয়েছে। মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নানারকম জীবনোপায় অবলম্বন করতে গিয়ে কেউ কোনোরকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন আবার কেউ বিলাসিতা করেন। কিয়ামতের আগে ‘মানুষের কাছে এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ উপার্জনের ক্ষেত্রে হারাম-হালাল বিবেচনা করবে না’ (বুখারি-২০৫৯, মুসলিম-১৩৮১)। অথচ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয় জিবরাইল আমার অন্তরে ওহি ঢেলে দিয়েছেন, অবশ্যই রিজিক শেষ হওয়ার আগে কারো মৃত্যু হয় না। সুতরাং তোমরা হারাম ছেড়ে হালাল পথে রিজিকের অনুসন্ধান করো’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৯/২৫৪)। তথাপি মানুষ রিজিকের পেছনে ছুটতে গিয়ে হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না।
আল্লাহ বলেছেন- ‘হে মানবকুল! তোমরা পৃথিবীতে হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বাকারাহ-১৬৮)। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে হালাল ও পবিত্র যা দিয়েছেন তা হতে আহার করো এবং আল্লাহর নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (সূরা নাহল-১১৪)।
হারাম উপার্জন ব্যক্তির সব নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। একজন ব্যক্তির দোয়া কবুলের অন্যতম শর্তই হলো তার উপার্জন হালাল হওয়া। এ ব্যাপারে রাসূল সা:-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে- এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করেছে। চুল উষ্কখুষ্ক। সে আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে ‘হে আমার রব!… হে আমার রব…!!’ বলে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, (মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন, সে হিসেবে তার দোয়াও কবুল হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে নবীজী বললেন,) ‘কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে? অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম অর্থের…’ ( মুসলিম-১০১৫, জামে তিরমিজি-২৯৮৯, মুসনাদে আহমাদ- ৮৩৪৮)।
হারাম উপার্জনের কিছু দৃষ্টান্ত
১. উৎকোচ (ঘুষ) : ঘুষের রাজত্ব আজ দেশের সর্বত্র আশঙ্কাজনক বেড়েছে। মাছি মারা কেরানি থেকে শুরু করে বড় কর্তাবাবুসহ প্রায়ই ঘুষের সাথে প্রকাশ্যভাবে জড়িত হয়ে গোটা জাতি এক অন্ধকারের কালো থাবায় আছড়ে পড়ছে। ঘুষের কবলে পড়ে আজ যোগ্যরা তাদের অবস্থান হারাচ্ছে। বকশিশ হলো ঘুষের প্রথম ধাপ। অথচ আল্লাহর রাসূল সা: ‘লানত করেছেন ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারীকে উভয়পক্ষকেই’ (আহমাদ-৬৫৩২, তিরমিজি-১৩৩৬)।
২. সুদ : ঘুষের মতো সুদের ব্যাপকতা লক্ষ করা যাচ্ছে সর্বত্র। প্রান্তীয় জনপদ থেকে নগরাঞ্চলে সর্বত্র আজ সুদের সাথে জড়িত এবং সুদভিত্তিক লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ মানুষ প্রকাশ্য সুদভিত্তিত জীবিকা উপার্জনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ, সুদের ব্যাপারে মহান রবের কড়া হুঁশিয়ারি রয়েছে- ‘যারা সুদ খায় তারা জিনে ধরা পাগল ব্যক্তির মতো হাশরের মাঠে দাঁড়াবে। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে, ব্যবসায় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন’ (সূরা বাকারা-২৭৫)। এ ছাড়া রাসূল সা: ‘সুদ ভক্ষণকারী, সুদদাতা, সুদের লেখক ও সাক্ষীকে অভিসম্পাত করেছেন’ (মুসলিম-১৫৯৭, তিরমিজি-১২০৬)।
৩. ওজনে কম দেয়া : ওজনে কম দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে- ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ। এরা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন মেপে দেয় তখন কম করে দেয়’ (সূরা মুতাফফিফিন : ৮৩/১-৩)। এ ছাড়া মাপে কম প্রদানকারীর শাস্তি সম্পর্কে রাসূল সা: কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘যখনই কোনো জনগোষ্ঠী মাপ ও ওজনে কম দেয়, তখনই তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি ও অত্যাচারী শাসকের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়’ (বুখারি-৩১১৮, মিশকাত-৩৭৪৬)।
৪. জাকাত প্রদান না করে সম্পদ ভোগ করা : জাকাত উপযোগী সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জাকাত আদায় না করে ওই সম্পদ ভক্ষণ করা হারাম। মহান আল্লাহর বাণী- ‘স্বর্ণ-রুপার মালিক যারা তার জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তা পাত বানানো হবে, অতঃপর তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার পার্শ্বদেশ, কপাল ও পিঠে সেকা দেয়া হবে’ (সূরা তাওবা-৯/৩৫)। এ ছাড়া রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে সম্প্রদায় তাদের সম্পদের জাকাত দেয় না, তাদেরকে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণও করা হতো না, যদি প্রাণিকুল না থাকত’ (ইবনে মাজাহ-৪০১৯, সহিহ-৪০০৯)।
৫. প্রতারণা, জুয়া ও বাজি ধরা : সব ধরনের প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি ইসলামে নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দিলো সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (মুসলিম-২৯৫, মিশকাত-২৮৬০, তিরমিজি-১৩১৫)। এ ছাড়া মহান আল্লাহ বলেন- ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা, ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও’ (সূরা মায়িদাহ-৯০)।
৬. চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও আত্মসাৎ করা : ইসলামে এ সবকে হারাম করা হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘চোর যখন চুরি করে তখন তার ঈমান থাকে না। ডাকাত যখন জনসমক্ষে ডাকাতি করে তখন তার ঈমান থাকে না’ (বুখারি-২৪৭৫, মুসলিম-৫৭)।
৭. চাকরির কাজে ফাঁকি দেয়া : যেকোনো চাকরিতে নির্দিষ্ট দায়িত্ব থেকে ফাঁকি দিয়ে ইনকাম করা সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ একটি কাজ। এটি তার দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আত্মসাৎ করার শামিল। কুরআন বলেন- ‘যে ব্যক্তি আত্মসাৎ করবে, সে কিয়ামত দিবসে আত্মসাৎকৃত বস্তু নিয়েই হাজির হবে’ (সূরা আলে ইমরান-১৬১)। এ ছাড়া রাসূল সা: বলেন, ‘যাকে আমরা কোনো কাজে নিযুক্ত করলাম, আর সে একটি সুতা বা তদূর্ধ্ব কিছু গোপন করল সেটি আত্মাসাৎ হিসেবে বিবেচিত। যা নিয়ে সে কিয়ামত দিবসে হাজির হবে’ (মুসলিম-১৮৩৩, আহমাদ-১৭৭৫৩)।
৮. পণ্য মজুদ করে রাখা : ইসলামে পণ্য মজুদদারি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য গোদামজাত করা হারাম কাজ। এতে করে প্রকৃত হকদার বঞ্চিত হয়। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্য গুদামজাত করে রাখল, তা হলে সে অবশ্যই আল্লাহ থেকে মুক্ত, আর আল্লাহও তার থেকে মুক্ত’ (সহিহাহ-৩৩৬২, আহমাদ-৪৮৮০, মিশকাত-২৮৯৫)। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে গুদামজাত করে সে পাপী’ (মুসলিম-১৬০৫, মিশকাত-২৮৯২)।
হারাম উপার্জনের ফলে ব্যক্তির ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। দোয়া কবুল হয় না। হারাম উপার্জনের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করা কখনোই উচিত নয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এমন অনেক জন্তু আছে, যারা আগামীকালের জন্য খাদ্য সঞ্চিত রাখে না। আল্লাহই রিজিক দেন তাদের ও তোমাদেরও। তিনি সর্বশ্রোতা তোমরা যা বলো, আর সর্বজ্ঞ যা তোমরা করো’ (সূরা আনকাবুত-৬০)। এ ছাড়া, অন্যত্র বলেন- ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে সোপর্দ করা হয়’ (সূরা হুদ-৬)। মহান রব, আমাদের সবাইকে হালাল জীবিকা অর্জনের তাওফিক দান করুন।
লেখক :
শিক্ষক ও গবেষক