মহাসমুদ্রে সারাদিন গোসল করলেও যদি পানির পিপাসা না লাগে তাহলে পানি পান করার চিন্তা মাথায় আসে না। তবে পানির পিপাসা পেলে তখন কিন্তু ঠিকই পান করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে তাহলে চাহিদা বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হলো চাহিদা বা চেতনা তাহলে কিসের ওপর নির্ভরশীল?
বেশ কিছুদিন লক্ষ্য করছি ইদানিং কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না বা মন চাইছে না। এ রকম প্রায়ই হয়, মাঝে মধ্যে এমনও মনে হয় আর হবে না আমার দ্বারা। ছোটবেলায় ব্যর্থ প্রেমে দাগা খেয়ে কবি বা শিল্পী হয়ে যেতাম আর তখন গানের সুরে গেতাম-প্রেম এসেছিল একবারই জীবনে- তবে পরে হিসেব করে দেখেছি এই গান ততোক্ষণই থাকত যতক্ষণ না নতুন প্রেমের সুযোগ আসত।
মানে প্রেম জীবনে একবার না, বাববার আসে, তবে তার প্রতিফলন শুধু যে বিচ্ছেদে ঘটে তা নয়, প্রেমের প্রতিফলন তার সঙ্গিনীর সাথেই বেশিরভাগ সময় সীমাবদ্ধ থাকে। যার ফলে দুটি মন এক সঙ্গে সুখের সাথে সংসার করে এবং ওই যে ওপরে লিখেছি মহাসমুদ্রে সারাদিন গোসল করলেও যদি পানির পিপাসা না লাগে তাহলে পানি পান করার চিন্তা মাথায় আসেনা তবে পানি পিপাসা পেলে ঠিকই পানি পান করতে ইচ্ছে করে।
চাহিদা কী? চাহিদা বলতে সাধারণ অর্থে আমরা কোনোকিছু পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাকে বুঝাই, কিন্তু অর্থনীতিতে শুধু আকাঙ্ক্ষাকে চাহিদা বলা যায় না। সেখানে কোনো দ্রব্য পাওয়ার ইচ্ছার পশ্চাতে অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য ও অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা থাকলে তাকে চাহিদা বলা হয়। সুতরাং কোনো ক্রেতার একটি নির্দিষ্ট দ্রব্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও আর্থিক সামর্থ্য থাকলে এবং নির্দিষ্ট দামে দ্রব্যটি ক্রয় করার ইচ্ছা থাকলে তবেই তাকে অর্থনীতিতে চাহিদা বলে।
কিন্তু জীবন শুধু অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যেমন ভালোবাসারও কিন্তু চাহিদা আছে। এমন কিছু সময় আসে জীবনে সবকিছু থাকতেও ভিন্ন ধরনের চেতনার উদয় হয় এবং তার পরিমাণ তীব্রাকারে বৃদ্ধি পায় তখন আমরা চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই।
চেতনা কী?
চেতনা হলো খুবই অপব্যবহৃত একটি শব্দ। শুধুমাত্র আমরা সচেতন বলেই আমাদের জীবনের অস্তিত্বকে বা বেঁচে থাকাটুকুকে অনুভব করতে পারি। কিন্তু যদি অচেতন হতাম তাহলে আমরা তো জানতেই পারতাম না যে আমরা জীবিত না মৃত। আমরা যা কিছু দেখি যেমন গাছ-পালা, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, কেঁচো, হাতি, বা মানুষ যাই হোক না কেন সবকিছুই সাদামাটা উপাদান দিয়ে (মাটি) গড়া। জীবনের সৃষ্টিকারক এই বুদ্ধিমত্তাকেই আমরা চেতনা বলি। আর শুধুমাত্র আমরা সচেতন বলেই জীবনের অস্তিত্বকে বা বেঁচে থাকাটুকুকে অনুভব করতে পারি। সত্যি কথা বলতে কী, চেতনাকে আমরা বাড়াতে বা কমাতে পারি না। এর মানে হলো, জীবনসংগ্রামটাই আমাদের কাছে মুখ্য, যা কিনা অন্যান্য প্রতিটি প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
যখনই নিজেকে আমরা এক শরীর হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই মুহূর্তেই আমাদের পরিচয়ের সীমারেখাটিও জমাট বেঁধে যায়। আমরা শুধু আমাদের শরীরের সাথেই চিহ্নিত, যাকে আমরা সকলেই ‘আমি’ বলে গণ্য করি। তাই আমরা কখনও চাই না যে, কোনো কিছুই আমাদের শরীরের সীমারেখাকে লঙ্ঘন করুক। এই চেতনা আমাদের সকলের মধ্যেই কিছু মাত্রায় রয়েছে। প্রশ্ন হলো কতটা? না, এটা জানা যাবে না এবং আমাদের চেতনাকে আমরা বাড়াতে পারব না।
যদি সঠিক ধ্যান করতে সক্ষম হই তবে আমরা নিজেদের এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হব যে আমরা চেতনার খোঁজ পাব এবং তাকে অনুভব করতে পারব। প্রকৃতপক্ষে, আমরা চেতনাকে বাড়াতে পারিনি এঅবদি, তবে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) তার বুদ্ধমত্তাকে দ্রুতগতিতে বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। যেহেতু এআই-এর রক্তে মাংসের শরীর না এবং নার্ভ সিস্টেম আমাদের মতো নয় সেক্ষেত্রে এআই সত্ত্বর আমাদের ডমিনেট করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় বিশ্বের রাজনীতিবিদরা ভীষণ আকারে ভাবনায় পড়েছে এবং এআই-কে বাধা হিসাবে বিবেচনা করছে। আমেরিকাসহ অনেক দেশই বাধা সৃষ্টি করলেও এআই-কে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এআই-র উন্নতির সাথে আমরাও আমাদের অনুভূতিকে বাড়িয়ে তুলতে পারব এবং আমরা নিজেরাই সচেতন হতে পারব। পৃথিবী সৃষ্টির পর একটা জিনিস পরিষ্কার সেটা হলো আমাদের চেতনা সর্বদাই বিদ্যমান। আমরা যে বেঁচে আছি—তার কারণই হলো আনাদের চেতনা। এখন যদি আমরা এই চেতনার সাথে চিহ্নিত হতে পারি, তখন প্রত্যেকের সাথে একাত্মবোধ অনুভব করতে পারব।
এটা কিন্তু আমরা একটি সময় অনুভব করি। আমরা তাকে বলি যৌনতা। আমাদের মনে যখন আবেগের প্রভাব বিস্তারিত হয়, তখন তাকে বলি প্রেম। কিন্তু যদি স্রেফ মানসিক প্রকাশ ঘটে, তখন লোভ, উচ্চাশা, বিজয়ের নেশা, কিংবা স্রেফ কেনাকাটার বাসনা জাগে। যৌনতা, প্রেমের সম্পর্ক, উচ্চাশাই হোক বিজয়ের নেশা— আসলে যা আমরা করতে চাই, তা হলো যা আমাদের নয়, তাকে নিজেদের অংশ করার চেষ্টা। যেসব উপাদান আমার হাতের পাঁচটি আঙুলকে তৈরি করেছে, তা এই পৃথিবীতে বহু আগে থেকেই ছিল — স্রেফ এখন তা আমার হাতের পাঁচটি আঙুলে পরিণত হয়েছে।
গতকাল আমার খাবারের থালায় খাদ্য হিসাবে যা ছিল, তা তো আর আমি নই। কিন্তু আমি তা খেয়েছিলাম, আর আজ আমি তাকে অনুভব করছি আমার নিজেরই অংশ হিসেবে। আসলে যেকোনও কিছুকেই আমরা নিজের অংশ বলেই অনুভব করতে পারি, যদি তাকে আমাদের আপন সীমানার অন্তর্ভুক্ত করে নিই। গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে আমরা খেতে পারব না বটে। তবে যেটা সম্ভব সেটা হলো আমাদের পরিধিগুলোকে নানাভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারব। অনুভূতির সীমানাকে এতটাই বাড়ানো যায় যে, আমি এখানে বসেই টের পাব গোটা ব্রহ্মাণ্ডে আমি একটি অংশমাত্র।
এই হলো চেতনা। চেতনা কোনও দার্শনিক কিংবা কোনও তাত্ত্বিক উপায়ে বৃদ্ধি করার ব্যাপার নয়— বরং অভিজ্ঞতা দিয়ে বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং এখনই সময় এআই- প্রযুক্তির সাহায্যে চেতনার সঠিক ব্যবহার করা। এআই-প্রযুক্তি যে বা যারা যত তাড়াতাড়ি শিখবে, তাদের সবার জন্যই তা কাজ করবে। এআই-কে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, এমনকী একে মাথায় তুলে বয়ে বেড়াতে হবে এবং এর সঠিক ব্যবহার করা শিখতে হবে, তাহলে কার্যসিদ্ধি হবে।
এখন যদি চেতনাকে জাগ্রত না করি তবে সঠিক চেতনার পরিবর্তে বেঠিক চেতনার উদয় হবে আর তখনই আমরা নিজেরাই শয়তান হয়ে শয়তানি করতে শুরু করব। শয়তানি করব আমরা আর দোষ দিব শয়তানের তা কি করে সম্ভব? তাই বলি নিজেকে সচেতন রাখুন এবং নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে চেতনার ভালো মন্দের দিক নির্দেশনার দায়ভার নিজে নিন।