রণজিতের পিতা মাতা গত হলেন। পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিলেন। চলে গেলেন ঐ না ফেরার দেশে। ও যে এতিম হয়ে গেল। একা একটি বাড়িতে কি করে থাকবে? কাজেই বড় ভাই অভিজিত বাবুর সিদ্ধাতে শহরে তার নিজের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হলো। ওখানেই শুরু হলো ওর নতুন জীবন যাত্রা। ভাইয়ের বৌ যেন ব্যাপারটা ঠিকভাবে মেনে নিতে পারছিলনা। আলাদা একটি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তাই তো দেবরের সঙ্গে তার খুনসুটি কারণে অকারণে বেঁধেই চলছিল। ছোট্ট মানুষ কি-ই বা করার আছে ওর। বৌদি যেভাবে চালাচ্ছে সেভাবেই চলে যাচ্ছে ওর দিন। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিচ্ছুটি যেন করার ছিল না। মাকে ভীষণ মনে পড়ছে ওর ! ইদানিং খাবারের সীমা রেখাটাও যেন শিথিল করা হয়েছে।
নবম শ্রেণীর ছাত্র পড়াটা যেন একটু কঠিনই মনে হচ্ছে। টিউশনি মাস্টারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বৌদি চাচ্ছে না, অতিরিক্ত কোন খরচ হোক। দাদা যে নিরুপায়, অন্য সমস্ত অসহায় দাদাদের মতোই। লোক লজ্জার ভয়ে শুধু স্কুলটা বাদ দিতে পারছিল না। রণজিত একেবারেই অসহায়, চোখের জল ব্যতিরেকে যেন অন্য কোন উপায় ছিল না ওর।
বন্ধুদের সহযোগিতায় লেখা পড়াটা কোন মতে -সতে চালিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আজকাল ঘরের চাকরের কাজগুলো যে ওকেই সামলাতে হচ্ছে। সে কারণে মাঝে মধ্যে স্কুলও কামাই দিতে হচ্ছে। একটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। এস,এস,সি পরীক্ষাটাও সন্নিকটে। বিদুৎ খরচ কমাতে ওকে দিনের আলোতে পড়াশুনা করতে হচ্ছে। উহুঁ ভীষণ চাপ। মাকে ভীষণ মনে পড়ছে। একজন মানুষ না থাকার কারণে পৃথিবীটা বড্ড কঠিন, অন্ধকার।
প্রচুর কষ্টের মধ্যে কাঠখড় পুড়িয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে রণজিত। পরীক্ষার রুটিন হাতে পেয়েছে। দাদা অভিজিত বাবু অন্তরে ভীষণ খুশী। কারণ একই রক্ত তো শরীরে বইছে। শুধু কোন হা করতে পারছে না। গো বেচারা ! দিনের এক ফাঁকে রণজিত বাবা মায়ের সমাধিতে গেল। কেননা রাত পোহাতেই ওর দশ বছরের সাধনার সমাপ্তি ঘটবে। ভোর রাতে একটুখানি রিভিউ, চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে মাত্র।
সকাল হতেই হঠাৎ করে বৌদির বাজারের ফর্মায়েস। ভীষণ অসন্তুষ্টি বোধ করছিল। কিন্তু না বলার সাহস ছিল না । ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখতে পেল হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। তাড়াহুড়ো করে বাজারে গেল। ফিরে এডমিট কার্ডটি হাতে নিয়ে দ্রুত পরীক্ষার তাগিদে বের হয়ে পড়ল। কিন্ত পরীক্ষার হলে পৌঁছতেই দাড়য়ান ওকে আটকে দিল। ওর কান্না আর্তনাদের চিৎকার শুনতেই শিক্ষকগণ বেরিয়ে আসলেন ! সান্ত্বনার কোন ভাষা তাদের ছিল না। কেননা তখন পরীক্ষার সময় দের ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে।
রণজিতের জীবনের চরম বিপর্যয় ঘটে গেল।বৌদির দুষ্টুমি চক্রান্তেই ঘড়ির কাঁটা ঘুড়িয়ে দের ঘন্টা পিছিয়ে রেখেছিল। এহেন কাজও কী মানুষ করতে পারে? রণজিত ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায় একেবারে বিহ্বল। জগতের নিকটে নিজেকে বড্ড মূল্য হীন বলে মনে হচ্ছিল। তাই তো রণজিতের আর কোনদিন দাদার বাড়িতে ফিরে আসা সম্ভব হলো না।
লেখক আমেরিকা প্রবাসী, কবি ও সাহিত্যিক
ৱত্না বাড়ৈ (হাওলাদাৱ)