জীবনের যাত্রাপথকে বয়স কিংবা সময় এমনকি গন্তব্য দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাটা সত্য। কিন্তু আমার জীবনের চলার পথ এসব অভিধা দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমার জীবনের গল্পে সময় কেবলই প্রহেলিকাময়। যেদিন আমার বাবা মারা যান, সে দিনটাকে শৈশবের চেয়েও দীর্ঘ মনে হয়েছিল আমার কাছে।
যেদিন আমি প্রথম সাফল্যের মুখ দেখি মনে হচ্ছিল সাফল্যটা ক্ষণিকের, ঘণ্টাখানেকের। আমি বিস্মিত হতাম, ফুড়ুৎ করে সময়ের চলে যাওয়া দেখে। এমনকি সময়ের কালক্রম আমাকে বিভ্রান্ত করত। বেশির ভাগ দিন আমি ভোরে সূর্য ওঠা পর্যন্ত কাজ করতাম। পৃথিবী যখন আলোর সাথে জেগে উঠত, তখন আমি ঘুমোতে যেতাম। আমার বন্ধুরা আমায় ডাকত পেঁচা, আমি নিজেকে বাদুড় ভাবতেই ভালোবাসতাম… বাদুড়… আঁধারের রাজপুত্র।
আমার গন্তব্যের বেলায় বলব, আমি মনে করি না আমি কাউকে চিনতাম। আমি আমার স্বপ্নের পথে হেঁটেছি, দৌড়েছি। চলার পথে অনেক কিছুই বদলেছে, মানুষ বদলেছে, আমি বদলেছি, পৃথিবীটা বদলেছে। এমনি আমার স্বপ্নগুলোও বদলেছে। আমার পৌঁছানোর কোনো জায়গা ছিল না। আমি শুধু সেটাই করে যাচ্ছিলাম যা আমি জানি কীভাবে সর্বোচ্চ ভালোটা করা যায় আর আমি তা পারব। হয়তো একদিন বৃদ্ধ হয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ব, হুইলচেয়ারে বসে পার্থিব সব ছাড়বার লড়াই করব। তবে তখন অবশ্যই সেই তরুণী আমার পাশে থাকবে।
আপনাদের আমি নিজের গল্প শোনাব, তবে সেটা আমি আমার মতো করে আমার চিন্তা-চেতনাকে ভাষায় ব্যক্ত করব। কিছু জিনিস জনপ্রিয়তা ও সাফল্যকে অতিক্রম করে যায়। চুলের রঙও ফিকে হয়। এটুকুন বুঝি যে, জীবনের হিসাব নির্ভর করে হৃদয়ের অভিজ্ঞতার বিস্তৃতির ওপর। তা বাদে আর কিছুই নয়। যদি আপনি এর মধ্য থেকে কিছু বের করে আনতে পারেন, তবে বেশ। অন্যথায়, আমার সর্বশেষ জনপ্রিয় গান চালু করে নাচতে শুরু করে দেব, সাথে থাকবে পানীয়। আর ইয়েলের ক্যাম্পাসে চুম্বন চর্চা করব আরও একবার।
যা হোক, যদি আমি ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ করি, দেখব যে, আমার জীবন আমার সৃজনশীলতায় কেন্দ্রীভূত। সৃজনশীল অভিব্যক্তি দিয়ে আমি জগৎটাকে আত্তীকরণ করেছি। বিনিময়ে পৃথিবী আমাকে অনেক অভিজ্ঞতা ফেরত দিয়েছে। আমি উপলব্ধি করেছি, পৃথিবী একদিকে সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ সততা হিসেবে তুলে ধরে; আরেক দিকে, সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ খ্যাতির (আকর্ষণ, সম্পদ) উত্থান হয় যা অনেকের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা এমনটা কেন করি? কারণ, আমরা তখন সৃষ্টিকর্তার চেয়ে নিজেদের বেশি ভেবে ফেলি। কখনো এই বোধটি সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভয়টাকে অকার্যকর করে ফেলে।
আমার পাগলামি সম্পর্কে বলি। একদিন অনেক রাতে, একটা পুরস্কার পাওয়ার পর মহানন্দে ঘরে ফিরছি। পরে পড়লাম, সে বছরের সবচেয়ে বাজে অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছি আমি। ‘বর্ষসেরা বাজে অভিনেতার জন্য সোনালি কলা’ সোজা বাংলায় এই হলো পুরস্কারের নাম। এটা জানার পর মন ভেঙে গিয়েছিল। ক্ষোভ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, কলা আর সমালোচক উভয়ের চামড়া ছাড়িয়ে বানরদের খাইয়ে দেই।
তখন আমি না পারছিলাম সব কিছু ছেড়ে দিতে, আর না পারছিলাম ধরে রাখতে। এই সময়ের সেরা কৌশল হচ্ছে : যখন আপনি এমন হতাশার জায়গায় থাকবেন, গোটা জগৎ আপনাকে খাটো করবে, তখন শুধু টিকে থাকতে চেষ্টা করবেন, আপনার ভেতরকার আপনিটাকে বের করে নিয়ে আসবেন। পৃথিবী আপনার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে যাবে, আপনাকে দেখতে পাবে না। সেই সময়ে আপনি নিজেকে নিজে দেখার চেষ্টা করবেন।
সৃজনশীল মানুষের জীবন অনেকটা শক্ত দড়ির মতো। জীবনের নাটকে আমি ঢিল দিতে শুরু করেছিলাম। যখন আমি দেখলাম, আমার জীবন বেড়ে উঠছে অন্যের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে যে আমার কী করা উচিত এ ব্যাপারটি আমাকে হতাশ করত। আর যখন কিনা মতবিরোধের শিকার হলাম, আমি আমার দর্শকের ভালোবাসা হারাতে লাগলাম। এটা অনেক কঠিন কাজ ছিল : একদিকে মানুষের কথায় কান না দেওয়া, অন্যদিকে নিজের সেরাটা দেওয়া।
তখন আমি যা করলাম তা হলো : আমি ক্রমাগত নাচছি আর গাড়ির চাকার মতো এক পায়ে ভর করে ঘুরছি। আর আমার পায়ে বাঁধা দড়িটায় টান পড়ছে। কিন্তু চেষ্টা করছি না পড়ে নিজেকে সামলে রাখতে। আমি পিছলাতে পারি কিন্তু মাটিতে পড়তে পারব না। এরই সাথে মুখে হাসি নিয়ে অটোগ্রাফ দিয়েছি। মনে মনে আমি আমার জীবনের দড়ি খেলায় কসরত করছি, আর বাইরে মানুষের আচরণ হজম করছি।
আমি নিজেকে একজন পথশিল্পী ভাবতে শুরু করলাম, যার দর্শক হলো পথচারী যারা খনিক থমকে দাঁড়িয়ে কৌতূহলে, করুণা কিংবা খুশি না হয়েও সাধুবাদ দিয়ে যায়। যখন আমি নিজের জীবনযাপন করি, আমার ভেতরকার সত্তা দর্শকের সারিতে বসে, আমার আচরণের তারিফ করে, আমার বোকামির জন্য হাসতে হাসতে গড়িয়েও পড়ে।
প্রিয় বন্ধুরা, নিজেকে নিয়ে হাসাহাসি করতে শেখো। নিজের ও নিজ জীবনের ওপর নিষ্ঠুর হবে না। নিজের জীবনের সাথে নিষ্ঠুর হওয়াটা নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো। মনে রাখা দরকার, সৃজনশীলতা হলো বিশেষ পাওয়া। কোনো কিছুর জন্য এটি বিনিময় করবে না। এমনকি প্রশংসা পাওয়ার জন্যও নয়।
গাড়ি-বাড়ি সব নয়। এগুলো ক্ষণিকের। তোমার মেধা বা তার বহির্প্রকাশ ছাড়া এসব কিছুই আসত না। গাড়ি-বাড়ি এসেছে আশপাশের মানুষের সাথে তোমার মেধার বহির্প্রকাশের ফলস্বরূপ। তোমার কাজ হলো নিজেকে উজাড় করে দেওয়া আর অনবরত শেখা। তোমার কর্ম তোমার জীবদ্দশায়ও সম্পন্ন হবে না। তোমার পরিপূর্ণতা তোমার সৃজনশীল কর্মে নিহিত, পণ্যে নয়। মনে রেখো, জীবন সব সময়ই একটা শক্ত দড়ি।
সৃজনশীলতা দিয়ে পেট ভরাবার চেষ্টা করবে না। সৃজনশীলতা আত্মার জন্য, ক্ষুধা নিবারণের জন্য নয়। রীতিনীতি অস্বীকার করতে ভয় পাবে না। যে নিয়ম শিল্প ও আত্মাকে হনন করতে পারে, তা ধ্বংস করতে ভয় পেও না। ক্ষুধার্ত হতে ভয় পেও না। যদি একাই হাঁটতে হয়, তথাপি ভয় করো না। কারণ একটা শক্ত দড়ি পায়ে বেঁধে আমাদের সবাইকে একাই হাঁটতে হয়। মনে রাখবে, যদি তুমি নির্মাণ-কারিগর হও, দড়ি-খেলোয়াড় হও, সেটা সবাইকে জানতে হবে এমন কথা নেই। একলা চলো।
যেমন, আমার জীবনটা সৃজনশীলতায় ভরা। আর দশটা মানুষের জীবন যেমন সুখের সন্ধানে কেন্দ্রীভূত, আমার জীবনও তার। তোমাদের বয়সটা এখন এমন একটা পর্যায়ে, যখন বেশির ভাগই দ্বিধায় পড়ে সুখ আর পরিতৃপ্তির সন্ধানে। আমি সোজাসাপটা বলতে চাই : তুমি যদি বুদ্ধিমান হও, যদি জীবনের নির্দয় ও কঠিন চ্যালেঞ্জে টিকে থাকতে চাও, তা হলে দেরিতে হলেও বুঝতে পারবে, যা তোমাকে দশ বছর আগে খুশি করতে পারত, এখন তা পারবে না। প্রিয় তরুণ বন্ধুরা, জ্বলে ওঠো আপন শক্তিতে, এখনই।