পণ্য জাহাজীকরণের চার মাসের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনার (প্রত্যাবাসন) নিয়ম রয়েছে। এ নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য রপ্তানির বিপরীতে যে পরিমাণ অর্থ দেশে আসার কথা, অনেক ক্ষেত্রেই তার ব্যত্যয় ঘটছে। এ কারণে যথাসময়ে রপ্তানি আয় দেশে আনতে সাম্প্রতিককালে তদারকি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে আগে থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ (ওভারডিউ) হয়ে যাওয়া রপ্তানি আয় দেশে আনার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, বর্তমানে দেশের ৫৫টি ব্যাংকে ওভারডিউ রপ্তানি আয় রয়েছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে, গত ডিসেম্বর ও চলতি জানুয়ারিতে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট ৪১ কোটি ডলারেরও বেশি অপ্রত্যাবাসিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৪১৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ পরিমাণ রপ্তানি আয় নিয়মানুযায়ী এখনো দেশে আসেনি। দেশি-বিদেশি ২০টি ব্যাংকে এর আধিক্য বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দেশে ডলার সংকট প্রকট হওয়ার পর গভর্নরের নির্দেশে আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্যও নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ফের চিঠি পাঠানো হয়েছে ব্যাংকগুলোতে।
চিঠিতে বলা হয়েছে বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ব্যবস্থায় জ্ঞাপিত নির্দেশনা অনুযায়ী পণ্য জাহাজীকরণের ৪ মাসের মধ্যে রপ্তানি মূল্য দেশে প্রত্যাবাসন করতে হবে। কিন্তু সর্বশেষ আপনাদের দাখিল করা ওভারডিউ রপ্তানি মূল্যের প্রত্যাবাসন সন্তোষজনক মর্মে লক্ষ করা যায় না। এ অবস্থায় ওভারডিউ রপ্তানি মূল্য সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের সহায়তায় প্রত্যাবাসন করে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হলো।
জানা যায়, আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যথাসময়ে রপ্তানি আয় দেশে আনতে গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিত তদারকি চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারি মাসের শুরুতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের (জুলাই-নভেম্বর)
রপ্তানির তথ্য চেয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ওভারডিউ রপ্তানি আয় এবং এর বিপরীতে প্রত্যাবাসনের তথ্যাদিও চাওয়া হয়। ব্যাংকগুলোর দাখিলকৃত তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে প্রায় ২ হাজার ৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে আগের বকেয়া ও নতুন রপ্তানি থেকে ১ হাজার ৮৫১ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। অন্যদিকে গত নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের বকেয়া স্থিতির পরিমাণ ছিল ৪৩৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে ওভারডিউয়ের পরিমাণ ছিল ৫৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। এ ওভারডিউ থেকে গত ডিসেম্বর ও চলতি জানুয়ারিতে প্রায় ১৩ কোটি ৫৪ লাখ ডলার দেশে এসেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এটি মোট ওভারডিউয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ। এ সময়কালে অন্তত ২৭টি ব্যাংক তাদের ওভারডিউয়ের ২০ শতাংশ অর্থও দেশে আনতে পারেনি। এগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ব্যাংক আল ফালাহ, এবি ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, কমার্সিয়াল ব্যাংক অব সিলন, ঢাকা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ওয়ান ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, এইচএসবিসি, ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংক। এর মধ্যে ৭টি ব্যাংকের হার শূন্য। একই সময়ে ১০ থেকে ১২টি ব্যাংকের ওভারডিউ রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের পরিমাণ ছিল ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, এখনো বেশকিছু ব্যাংকে অধিক পরিমাণ ওভারডিউ রপ্তানি আয় রয়েছে। এগুলো হলোÑ অগ্রণী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, যমুনা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, দ্যা সিটি ব্যাংক, এইচএসবিসি, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্ট মাসেও ব্যাংকগুলোয় চিঠি পাঠিয়ে অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময় তৈরি করা এক প্রতিবেদনে স্বাভাবিক নিয়মে ওভারডিউ হওয়া রপ্তানি মূল্য দেশে না আসায় তা পাচার হয়েছে মর্মে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।