মালয়েশিয়ায় জনগণের নতুন সরকার গঠন হওয়ার পরও দাতো আমিন নুর গংদেরকে কোটা ও সিন্ডিকেট খরচের নামে প্রতি কর্মীর বিপরীতে দেড় লাখ টাকারও বেশি আন্ডারহ্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এই সিন্ডিকেটের খরচ কোনো কারণে দিতে বিলম্ব হলে মালয়েশিয়ার এফডব্লিওসিএমএস সিস্টেম থেকে ওই এজেন্সির কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশ থেকে শ্রমিক যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্নের পরও যেতে বিলম্ব হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা নাম না প্রকাশ করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, কর্মীপ্রতির জন্য দাতো আমিন নুর গংয়ের এদেশীয় এজেন্টদেরকে মালয়েশিয়া সরকারের লেভী এবং অন্যান্য সরকারি খরচের বাইরে অতিরিক্ত আরো টাকা মিলিয়ে একজন বিদেশগামীর জন্য বিপরীতে টাকা দিতে হচ্ছে। এর ফলে শ্রমিক যেতে ৪-৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এর কমে আজ পর্যন্ত কোনো শ্রমিক দেশটিতে যেতে পারেনি বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও তারা বিদেশ না যেতে পারার ভয়ে প্রকাশ্যে বেশি টাকা দিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করছে না। সাধারণ এজেন্সির মালিকরা দাবি করছেন, যদি আমিন নুর গংদের এই সিস্টেমের অতিরিক্ত টাকা না দিতে হতো, তাহলে তারা সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় দেশটিতে একজন কর্মী পাঠাতে পারতেন।
যদিও সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় নতুন সরকার গঠন হওয়ার পর দেশটির জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম তার কেবিনেট বৈঠকে অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও ফরেন ওয়ার্কার আনার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সংশ্লিষ্টরা কেবিনেট বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, অতিরিক্ত অভিবাসন ছাড়া ঝামেলামুক্তভাবে যাতে বিদেশী শ্রমিক আসতে পারে সেজন্য শ্রমিক আনার পদ্ধতি আরো সহজ করার কথা তিনি বলেছেন। তবে কাউকে সিন্ডিকেট করে মালয়েশিয়ায় ব্যবসার সুযোগ দেয়া হবে না বলেও তিনি বলেছেন। এখন নতুন ফর্র্মুলা কি হতে যাচ্ছে সেটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে এই সেক্টেরের সাথে সম্পৃক্তদের।
এমনটি মনে করছেন সাধারণ এজেন্সি মালিকরা। গতকাল মালয়েশিয়া থেকে একজন অভিবাসন বিশ্লেষক নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়া সরকার সিস্টেম রাখবে কি রাখবে না এ নিয়ে শিগগিরই একটি ঘোষণা আসার কথা রয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে শোনা যাচ্ছে সিস্টেম পরিবর্তন হচ্ছে। আবার যদি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার চালু হয়, তাহলে এটা কোনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে ভেতরে ভেতরে। তবে দাতো আমিন নুরের এফডব্লিওসিএমএস সিস্টেম থাকবে না বলেই শোনা যাচ্ছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফর করেন ইন্দোনেশিয়াতে। সেখানে দেশটির পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, তারা দাতো আমিন নুরের সিস্টেম ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়া কোনো শ্রমিক পাঠাবে না। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই অভিবাসন বিশ্লেষক বলেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বিদেশী শ্রমিকরা যাতে কম টাকায় এবং সহজে আসতে পারে সেজন্য তিনি বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার দেশের মাই ইজি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকদের অ্যাপ্রুভাল দেবে। ১০ দিনে কলিং দেবে। এসব ভালো দিক।
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক সিন্ডিকেট করে শ্রমিক পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে ৬৮টি রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ন্ত্রণ করছে মালয়েশিয়ার বংশোদ্ভূত দাতো আমিন নুর গং। বাকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে বায়রার অপর একটি অংশ। মালয়েশিয়ার সাবেক মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানানের সাথে আমিন নুরের ঘনিষ্ঠতার কারণে দুই দেশের বিরোধিতার পরও এই সিন্ডিকেট গঠিত হয়।
গতকাল একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ঢাকা ও কুয়ালালামপুর থেকে নয়া দিগন্তকে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা প্রসঙ্গে বলেন, মালয়েশিয়া সরকারের লেভি এবং অন্যান্য যে সরকারি খরচ রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে এখনো দাতো আমিনের সিস্টেম এফডব্লিওসিএমএসের জন্য সিন্ডিকেটের এ দেশি প্রধানের অফিসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নিচ্ছে। টাকাগুলো তার দফতরে এজেন্সি মালিকরাই নিজ গরজে পৌঁছে দিচ্ছে। এ দেশীয় এজেন্টের মাধ্যমে ওই টাকাগুলো চলে যাচ্ছে দাতো আমিনের কাছে। এই টাকা ক্যাশ না দিলে সিস্টেম থেকে তার পাসওয়ার্ড ব্লক করে দেয়া হচ্ছে। মালয়েশিয়া সরকার এই সিন্ডিকেটের বিষয়টি জেনে সহজভাবে কর্মী আনার বিষয়ে ভাবতেছে এবং শিগগিরই পরিবর্তন আসতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। যোগ করেন তারা।
দুই দিন আগে মালয়েশিয়া থেকে একজন অভিবাসন ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তকে শুধু বলেন, দাতো আমিন নুর ও স্বপন গংরা শ্রমবাজারে সমস্যা তৈরি করছে। ইতোমধ্যে তারা যেসব এজেন্সি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তাদের প্রতিনিধিত্ব করা ১১টি মেডিক্যাল সেন্টারের কার্যক্রম সিস্টেম থেকে বাদ দিয়েছে। যার কারণে ওই মেডিক্যাল সেন্টারগুলো কাজ করতে পারছে না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সিন্ডিকেটের জনক দাতো শ্রী আমিন নুরের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ও এ দেশীয় এজেন্ট স্বপনের মোবাইলে বারবার টেলিফোন করার পরও তারা কেউ সাড়া দেননি।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, শোনা যাচ্ছে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে (সম্ভবত ২ ফেব্রুয়ারি) মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী সিভাকুমার ভারাথারাজু নাইদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল ও ডাইরেক্টর জেনারেল অব ইমিগ্রেশন খাইরুল দাইমি দাউদ বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তাদের সফরের উদ্দেশ্য শ্রমিক আসার গতি স্লো কেন তার খোঁজখবর নেয়ার জন্য। তবে আমরা এখনো অফিসিয়ালি কোনো চিঠি পাইনি।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। এখনো বহু শ্রমিক যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ শ্রমিককে এজেন্সি মালিকরা বিদেশ পাঠানোর জন্য মেডিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের জটিলতার কারণে বেশির ভাগ বিদেশগামীর মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এতে অসহায় শ্রমিকদের খরচ আরো বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি পুত্রজায়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল বিদেশী শ্রমিক প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ১৫টি সোর্স কান্ট্রি থেকে শ্রমিক আনার জন্য আবেদনকারী নিয়োগকর্তারা তিন দিনের মধ্যে তাদের অনুমোদন করাতে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, আমাদের বিদেশী কর্মীদের প্রবেশের অনুমোদন দেয়া সহজ করতে হবে এবং আমাদের অবিলম্বে এটি করা দরকার। নিয়োগকর্তাদের আবেদন জমা দিতে হবে এবং আমরা এই পরিকল্পনার অধীনে তিন দিনের মধ্যে অনুমোদন দেবো। উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো এবং সরকার অনুমান করেছে যে আমরা যদি সাতটি খাতে চাহিদা মেটাতে বিদেশী কর্মীদের প্রবেশ সহজ ও দ্রুত করি তাহলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১% বৃদ্ধি পাবে। অনুমোদিত খাতগুলো হলো- শিল্প, নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, কৃষি, সেবা, গৃহকর্মী, খনি ও খনন। সোর্সভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখাস্তান, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও ভিয়েতনাম। সরকার নতুন নীতি ব্যাখ্যা করতে এবং তাদের চুক্তি পেতে এসব দেশে প্রতিনিধিদল পাঠাবে। যোগ করেন তিনি।