দেশে ডলার সঙ্কটের কারণে অন্য অনেক খাতের মতো প্রভাব পড়েছে দেশের মুদ্রণ শিল্পের ওপরেও। ফলে নতুন বই প্রকাশ আর পড়াশোনায় দরকারি সাদা কাগজের সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রকাশক ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক দিনে বাজারে কাগজের দাম গত এক মাসের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। আবার আমদানি কম হওয়ায় ভালো মানের পর্যাপ্ত কাগজও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফলে তারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে এক দিনে যেমন বছরের শুরুতে স্কুলগুলোর পাঠ্যপুস্তক হাতে পাওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে, আরেকদিকে বই মেলার অনেক বইয়ের প্রকাশ আটকে যেতে পারে।
কী জটিলতা তৈরি হয়েছে?
বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প গুরুতর একটা সঙ্কটে পড়েছে। এটা এখনি সমাধান করা না গেলে সামনের বছর শুধু প্রাথমিকের বিনামূল্যের ৩০ লাখ বই নয়, অন্য ক্লাসের, নাইন-টেনের, ইন্টারমিডিয়েটের সব বই পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’
প্রকাশকরা জানান, অগাস্ট থেকেই বাজারে কাগজের সঙ্কট শুরু হয়েছে, এখন সেটা গুরুতর অবস্থায় পৌঁছেছে। এর মধ্যেই কাগজের রিমের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এমনকি বেশি টাকা দিয়েও কাগজ পাচ্ছেন না অনেক প্রকাশক।
শ্যামল পাল জানান, তিনমাস আগেও যে কাগজের রিম ১৫০০ টাকায় পাওয়া যেত, তা এখন চার হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ফলে গত কয়েক বছর ধরে জানুয়ারির শুরুতে প্রাথমিকে যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনেক প্রকাশক জানিয়ে দিয়েছেন, কাগজ সঙ্কট ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে তারা ঠিক সময়ে বই সরবরাহ করতে পারবেন না।
পাশাপাশি অন্য পাঠ্যপুস্তকের দাম আগের তুলনায় দেড় থেকে দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রকাশকরা। সেই সাথে স্কুল-কলেজের পড়াশোনায় প্রয়োজনীয় সাদা কাগজের অভাব বা দাম অনেক বেড়ে যাওয়ারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তারা।
কারণ বছরের শেষ দিকে নানা বই ছাপানো, ক্যালেন্ডার-ডায়েরি থেকে শুরু করে মুদ্রণ খাত কাজ বেড়ে যায়।
শ্যামল পাল বলেন, ‘আমাদের র’ ম্যাটেরিয়াল নেই, বিদ্যুৎ নেই। নতুন বছরে ডজন ডজন খাতা লাগবে। আরো বিভিন্ন খাতে কাগজ লাগে বাংলাদেশে। ইমপোর্টও হচ্ছে না। এখন কাগজ যা আছে, তা দিয়ে হয়ত আরো কয়েক দিন চলবে। কিন্তু দ্রুত কাগজ উৎপাদন বা আমদানি করা না গেলে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়তে হবে আমাদের।’
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের বড় একটি ব্যবসার সময় অমর একুশে বই মেলা। আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি বলেন, ’কাগজের এই সঙ্কট অব্যাহত থাকলে বইমেলাতে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। আর যেভাবে কাগজের দাম বেড়েছে, বইয়ের দামও অনেক বেশি হয়ে যাবে।‘
কুমিল্লার বইপত্র ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান নামের একজন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ’আমার এখানে কাগজের যে চাহিদা, তার তিনভাগের একভাগ কাগজও পাচ্ছি না। সমস্যা এই রকম থাকলে স্কুল-কলেজের নতুন ক্লাস শুরু হলে কাউকে কাগজ আর দিতে পারবো বলে মনে হয় না।’
কেন এই সমস্যা?
বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের কাগজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বইপত্র ছাপানো বা পড়াশোনার কাজে হালকা কাগজ ব্যবহৃত হয়। এর পুরোটাই দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত হয়। এই খাত সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে।
অন্যদিকে ক্যালেন্ডার, প্যাকেজিং বা গার্মেন্টস শিল্পে ভারী কাগজ দরকার হয়। যা দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন বাজারে উভয় ধরনের কাগজের সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কাগজ কারখানার কাঁচামাল পাল্প আমদানির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। সেই সাথে গত দু’বছর করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় দেশীয় উৎস থেকে রিসাইকল করার মতো কাগজও পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে লেখা ও ছাপার জন্য বছরে ১০ লাখ টন কাগজের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগটা দেশে উৎপাদিত হয়।
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং পেপার আমদানির সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির উপকরণ পাল্প আমদানি করা হয়। সেই সাথে ভারী কাগজ আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয়। আর কিছু কাগজ পুরনো বইপত্র-পেপার রিসাইকল করে তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশে ২০৬টি পেপার মিল রয়েছে, যার মধ্যে চালু রয়েছে প্রায় ৮০টি কারখানা। লেখা ও ছাপার কাগজের কাজ করে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টি কারখানা।
আম্বার পেপার মিলস লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দুই একটি ছাড়া অন্য কোন কারখানার কাছে কাগজ তৈরির কাঁচামাল পাল্প নেই। ফলে কোনো কারখানায় কাগজ তৈরি হচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠান বাতিল কাগজ বা বইপত্র রিসাইকল করে, তারা কিছু কিছু উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কাছেও পর্যাপ্ত কাঁচামাল নেই। ফলে কেউ বাজারে কাগজের যোগান দিতে পারছে না।’
বাংলাদেশের কাগজ কারখানাগুলোর কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু ডলারের দাম দেড়গুণ হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের এর আগে আমদানি করা পাল্পের জন্য দেড়গুণ বেশি খরচ করতে হয়েছে। ফলে লাভ বাদ দিয়ে অনেকে ক্ষতির শিকার হয়েছে।
আবার নতুন করে কাঁচামাল আমদানি করতে গেলেও ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এর কারণ হিসাবে তারা ডলার সঙ্কটকে দায়ী করেছে।
বাংলাদেশ পেপার ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং এফবিসিসিআই পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘গত দুইমাস ধরে আমরা এলসি খুলতে পারছি না। ব্যাংকের কাছে গেলেই তারা আমাদের রিফিউজ করে দিচ্ছে। মূলত ডলার সঙ্কটের কারণেই বাজারটা অ্যাফেক্টেড হয়ে গেছে।’
আমদানি করা কাগজ দিয়ে মূলত প্যাকেজিং, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা ক্যালেন্ডারের মতো খাতে কাজে লাগানো হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে আগের তুলনায় কাগজের দাম কিছুটা পড়ে গেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ শিল্পের সুরক্ষা দিতে আমদানি করা কাগজের ওপর অনেক শুল্ক আরোপ করা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই শুল্কের হার ৬০ শতাংশের বেশি।
শ্যামল পাল বলেন, ’বাতিল কাগজের সাথে পাল্প মিশিয়ে অনেক কারখানায় নতুন কাগজ তৈরি হয়। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ফলে বাতিল কাগজপত্র তেমন তৈরি হয়নি। তাই মিল রিসাইকেল করার জন্য কাগজ পাচ্ছে না। এদিকে নতুন পাল্পও আমদানি করতে পারছে না। ফলে কারখানাগুলো কাগজ তৈরি করতে পারছে না।’
সেই সাথে কারখানাগুলোয় গ্যাস আর বিদ্যুতের সঙ্কটেরও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সঙ্কটের সমাধান করতে কী করা হচ্ছে?
কাগজের সঙ্কটের এই বিষয় নিয়ে এর মধ্যেই একাধিকবার বৈঠক করেছে এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু ডলার সঙ্কটের মধ্যে থাকা বাংলাদেশে এখনো এর কোনো সমাধান বের হয়নি।
প্রকাশকরা দাবি করছেন, সঙ্কট সামলাতে তাদের যেন সাময়িকভাবে, কয়েকমাসের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু তাতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় আপত্তি রয়েছে কাগজ মিল মালিকদের।
শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ’তারা ওইভাবে কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। তারা বলছে, এখন তো ডলার সঙ্কট, খুব শীঘ্রই ভালো হবে। এই ধরনের আশ্বাস দিচ্ছে। আমাদের কেউই এলসি খুলতে পারছে না।’
কাগজ মিল পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান মনে করেন, ডলার সঙ্কট না যাওয়া পর্যন্ত এর সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
তবে কয়েক দিন আগে প্রকাশকদের সাথে একটি আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি বলেন, বিশ্ব একটি কষ্টকর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মুদ্রণ শিল্পের যা যা সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানের চেষ্টা চলছে।
এই প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, প্রতিটা ব্যাংক তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী এলসির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদাভাবে এলসি খোলা বা বন্ধের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত বাজারে ডলার সরবরাহও করে যাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি