মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুক্তারপুর এলাকায় পুলিশের সাথে বিএনপির সংঘর্ষে যুবদলকর্মী শহিদুল ইসলাম শাওনের (২৬) মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস।
‘না মাইরা হাত ভাইঙ্গা দিতো, নাইলে একখান পা ভাঙতো। তা না করে গুল্লি করে ওরা আমার তরতাজা নাতিডারে মাইরা লাইলো। কি করে মরলো নাতিডা..? মনে হয় কইতরের মতো দাপাইলো।’ এভাবেই নিহত নাতির জন্য আহাজারি করছিলেন মুন্সিগঞ্জের যুবদলকর্মী শহিদুল ইসলাম শাওনের (২৭) দাদি ষাটোর্ধ্ব হালিমা বিবি। প্রিয় নাতিকে হারিয়ে শোকে কাতর তিনি।
হালিমা বিবি বলেন, ‘আমি কই যামু, আমার নাতিডারে তো আর পামু না। শাওনরে তো আর পামু না বাবা।’ বিচার চান কি না এমন প্রশ্নে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধার কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব। বলেন, ‘এগুলো কইয়া কী হইবো? বিচার তো পামু না। ঈমানে যদি লয়, তাইলে বিচার করবো। কী বিচার করবো, শাওনরে তো আইনা দিতে পারবো না।’
শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মুন্সিগঞ্জ মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা এলাকায় নিহতের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
শাওনের লাশ কবরের জন্য শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে স্থানীয় মুরমা জামে মসজিদ সংলগ্ন সামাজিক কবরস্থানে কবর খোঁড়া হয়। তবে শাওনের মৃত্যুর সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পর (রাত ৭.৩০ পর্যন্ত) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে তার লাশ স্বজনরা বুঝে পেয়ে রওয়ানা দিয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শাওনের লাশ মুন্সীগঞ্জ এসে পৌঁছায়নি।
বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে পুলিশের সাথে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন শাওন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ওইদিন রাতেই ঢাকায় আনা হয়। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয় তাকে। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টা ৪৮ মিনিটে সেখানে মারা যান শাওন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের হাতে ভাত খেয়ে যান শাওন। কিছুক্ষণ পরই পরিবারের লোকজন খবর পান শাওন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
সেই কথায় বার বার আওড়াচ্ছেন শাওনের মা লিপি বেগম। তিনি বলেন, ‘পোলাডা আমার কাছে ভাত চাইলো। আমি তাড়াতাড়ি দিলাম, ও খেয়ে গেলো। ওই যে গেলো, আর আইলো না। একটু পর হুনি গুলি খেয়েছে আমার শাওন। কালকে (বৃহস্পতিবার) রাতে খবর আইলো, পোলাডা আর নাই। ওরা আমার পোলাডারে এমন করে কেন মারলো?’ এমন প্রশ্ন মায়ের। লিপি বেগম আরো বলেন, ‘অটোরিকশা চালাতো শাওন। ডেইলি আনে, ডেইলি খাই। এখন আমাগো কে দেখবো?’
স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ শাওনের স্ত্রী সাদিয়া। বার বার অচেতন হয়ে পড়ছেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাদিয়া বলেন, ‘আমার ছেলেটার বয়স আট মাস। ওর এখন কী হবে? আমার স্বামীকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই।’
শাওন সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা গ্রামের ছোয়াব আলী ভূইয়ার ছেলে। চার ভাই ও একবোনের মধ্যে শাওন সবার বড়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষমও ছিলেন এ যুবক।
এলাকায় নম্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত ছিল নিহত শাওন। প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শাওন কারো সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেছেন, এমনটি তারা কখনো শোনেননি। এলাকায় ভদ্র ও ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। যা আয়-রোজগার করতেন, তা দিয়ে বাবা-মাসহ পরিবার নিয়ে কোনোরকম জীবনযাপন করতেন।
বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মুন্সীগঞ্জে বিএনপির বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে মুক্তারপুরের ফেরিঘাট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষ চলে।
সংঘর্ষে পুলিশের এএসপি, সদর থানার ওসিসহ ৩৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। এছাড়া বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহের সময় আহত হয়েছেন তিন সাংবাদিকও।
সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় যুবদলকর্মী শাওন ও জাহাঙ্গীর নামের আরেকজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাওনের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে এ ঘটনায় পুলিশ ও শ্রমিক লীগের এক নেতা দুটি মামলা করেছেন। দুই মামলায় ৩৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে এক হাজার ৩৬৫ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে বিএনপির ২৫ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।