আবার ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালে বাতিল হওয়া প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। তার আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরের বিদ্যমান অবস্থা এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অবস্থার ধারণাপত্র বানিয়ে পাঠানো হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের কাছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়েকে জরুরি বলছেন বিশেষজ্ঞরাও।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের যোগাযোগ সহজ করতে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এর অনুমোদন দেয়। কিন্তু বাস্তবায়ন করবে কে, তা নিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) এবং সেতু বিভাগের মধ্যে টানাটানি চলে। সওজ প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে সমীক্ষা চালায়। তার পর ২০১৯ সালে এক্সপ্রেসওয়ে বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, এ রুটে হাইস্পিড ট্রেন চালু করতে হবে। এ জন্য রেলের মাধ্যমে ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ করা হয় সমীক্ষা ও বিশদ নকশার কাজে। বিনিয়োগকারীর অভাবে হাইস্পিড ট্রেনও অনিশ্চয়তার খাতায়। এখন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলছেÑ ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে খুবই জরুরি। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বিদ্যমান চার লেন চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। আর প্রস্তাবিত বুলেট ট্রেনের মাধ্যমে কেবল
কোন সেগমেন্টে সড়কের ‘রাইট অব ওয়ে’র আওতাধীন জমির পরিমাণ কত রয়েছে, এর অবস্থান এবং বিদ্যমান সড়কের উভয় পাশের বর্তমান অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করতে সওজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। সেখানে সংক্ষিপ্ত এবং দীর্ঘমেয়াদে কী করা যায়, তার ধারণাপত্র দিতে বলেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব এবিএম আমিনউল্লাহ নুরি আমাদের সময়কে বলেন, ‘আগে প্রস্তাবটি একবার বাতিল করা হয়েছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যালোচনা করা হয়েছে। আরও কিছু কাজ বাকি আছে। এর পর পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবার পাঠানো হবে।’
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগে এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি। উদ্যোগটি বাতিল করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। হাইস্পিড ট্রেনের সিদ্ধান্ত ভুল, তা বুঝতে সমীক্ষার দরকার নেই। এখন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেসওয়ে করার কথা বলা হচ্ছে। এটিও দরকারি। পর্যটন, এনার্জি হাব থেকে শুরু করে নানা কারণে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার আগে তো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়েটি করা দরকার। বরং ঢাকা-মাওয়ার আগেই চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে করা উচিত ছিল। এখন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সুযোগ পর্যাপ্ত আছে কি? ওই মহাসড়ক ধরে অবকাঠামো নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে। নতুন করে জমি অধিগ্রহণেও খরচ বাড়বে। অথচ তখনই প্রকল্পটির কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত ছিল।’
জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সময় বাঁচাতে তাই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সওজ। সমীক্ষা পর্বসহ নানা ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে আসে সেতু বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধাপ। সওজের মাধ্যমে প্রকল্পটি অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায় সেতু বিভাগ অবশ্য পরে পিছু হটে।
পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের ‘রেজিস্ট্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ আহ্বান এবং ভিজিএফ (ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং) চূড়ান্তকরণও হয়। এর কিছু দিন পর যখন নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা, তখনই প্রকল্পটি বাতিলের ঘোষণা আসে। অথচ এসব কাজে সময় গেছে ৮ বছর; ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এর পর সিদ্ধান্ত আসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালুর। বর্তমানে এ পথে যাতায়াতে অন্তত ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। হাইস্পিড তথা বুলেট ট্রেন চালু হলে সময় লাগবে ৫৫ মিনিট। দ্রুতগতির এই ট্রেন চালু করতে খরচ পড়বে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ খরচ করে রেলওয়ের জন্য এই প্রকল্প কতটি বাস্তবসম্মত হবে, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সরকারের ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে হাইস্পিড ট্রেনের সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইনে।
একজন যাত্রীকে হাইস্পিড ট্রেনে যাতায়াতে কিলোমিটারে ১০ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে হিসাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে খরচ পড়বে প্রায় ৩ হাজার টাকা। প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব বলে সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়। ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে বুলেট ট্রেন। যদিও এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে আসছে রেল। তার কারণ এ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করার মতো আগ্রহী কাউকে মিলছে না। একই বিষয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পরামর্শক নিয়োগের অনুমোদন মেলে। ওই বছরের ১৪ জুলাই সওজের সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর উড়ালপথ ও সমতল সমন্বয়ে নকশা (ডিজাইন) জমা দেয় সওজে। ঢাকা-কুমিল্লা ৮৪ কিলোমিটার, কুমিল্লা-ফেনী ৫২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং ফেনী-চট্টগ্রাম ৮০.৯৫ কিলোমিটারÑ তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত করার সুপারিশ করে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার। এর পর ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল পিইসি সভার সুপারিশ অনুযায়ী ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়। সওজের পক্ষ থেকে নির্মাণের সময়কাল ধরা হয় ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল। সেই হিসাবে তখন কাজ শুরু করলে চলতি বছরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের মাধ্যমে পৃথকভাবে প্রকল্প হাতে নিয়ে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হয়। এ নিয়ে সওজ ও সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে সওজের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত আসে। এর পর ২০১৮ সালেল ১৫ মে অর্থ বিভাগ কর্তৃক প্রকল্পের ভিজিএফ (প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৩০ শতাংশ) প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। এর পর পিপিপি কর্তৃপক্ষ এডিবি ও বুয়েটকে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার হিসাবে নিয়োগ দেয় সওজ। ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্যাকেজের (ঢাকা-কুমিল্লা) অংশের জন্য ‘রেজিস্ট্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ আহ্বান করা হয়। ওই প্রস্তাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দেয়। কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে প্রকল্পের কার্যক্রম বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে। পরে বিদ্যমান চার লেনের সঙ্গে আরও চার লেন এবং মহাসড়কের উভয় পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণের প্রস্তাব পাঠায় সওজ। সেই হিসাবে একটি পৃথক প্রকল্পের কাজে পরামর্শক নিয়োগের কারিগরি মূল্যায়ন প্রক্রিয়াধীন।
সূত্রমতে, এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইস্পিড ট্রেনের তুলনামূলক একটি বিবরণী প্রস্তুত করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সেখানে বলা হয়, অ্যাটগ্রেড ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জন্য জমি লাগবে ৮০০ হেক্টর। খরচ পড়বে ৩৬০ কোটি ডলার। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ২১৭ কিলোমিটারে জমি লাগবে ৪৫০ হেক্টর। ব্যয় হবে ৮৮০ কোটি ডলার। অন্যদিকে হাইস্পিড ট্রেনের জন্য ২৪০ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ৬০০ হেক্টর জমি লাগবে। নির্মাণ ব্যয় হবে ১৪৮০ কোটি ডলার। এখন অ্যাট-গ্রেড ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে চাইলে শুধু পরামর্শক নিয়োগ করে আগের স্টাডি রিপোর্ট আপডেট করলেই হবে। এই এক্সপ্রেসওয়ে যাত্রী ও পণ্য, উভয়ের ব্যবহার উপযোগী। চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কাজে এটি সহায়ক হবে। অন্যদিকে হাইস্পিড ট্রেন মূলত যাত্রী পরিবহনের জন্য। এ ছাড়া ২০২৪ সালের মধ্যে এ মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা বিদ্যমান চার লেনের ধারণক্ষমতার বাইবে যাবে। সে জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি বলে মনে করছে সওজ।