২০১৭ সালে একবারে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঠেলে দেয় মিয়ানমার। এখন সেখানে থাকা আরো ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের সীমানায় ঠেলে দিতে চাইছে। আর সে লক্ষ্যে বাংলাদেশকে যুদ্ধের ফাঁদে ফেলার অপচেষ্টা করছে মিয়ানমার।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তারা মিয়ানমারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ওসমান বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার মগ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন করে এ দেশে পাঠিয়েছে। এখনো প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমারে অবস্থান করছেন। তাদেরকেও জুলুমের মাধ্যমে আবার এই দেশে পাঠাতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে মিয়ানমার। সীমান্তে উত্তেজনা তারই ইঙ্গিত বহন করে বলে আমি মনে করছি। উখিয়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, বহুমুখী ষড়যন্ত্রের গোলা তুমব্রু সীমান্তে। কঠিন প্রস্তুতি ও ধৈর্যের সাথে পাতানো ফাঁদের পরিস্থিতি অতি কৌশলে মোকাবেলা করাই উত্তম বলে মনে করছি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গোলাগুলি চলছে। রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে এক রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এতে এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই কিশোরের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া কিশোরের নাম মো: ইকবাল (১৫)। সে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা মুনির আহমদের ছেলে। আহত পাঁচ রোহিঙ্গার মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন- জাহিদ আলম (৩০), নবী হোসেন (২১), মো: আনাস (১৫) ও সাহদিয়া (৪)।
তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পাঁচ বছর ধরে আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে বসবাস করছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত চার হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবির ঘেঁষে (পেছনে) মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড়। পাহাড়ের উপর রয়েছে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক তল্লাশিচৌকি।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, তিন দিন ধরে আশ্রয়শিবিরের পেছনের পাহাড়ে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে পাহাড়ের চৌকি থেকে ব্যাপক হারে গুলি ছোড়ার পাশাপাশি মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। গোলাগুলি চলছে। কিন্তু কী কারণে এত বেশি গোলা ও মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন।
৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি ভারী অস্ত্রের গুলি তুমব্রু বাজারের পাশে কোনারপাড়ার কৃষক শাহজাহানের বাড়ির আঙিনায় এসে পড়ে। বাড়ির পাশেই শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। এর আগেও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দু’টি মর্টার শেল এসে পড়ার ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা জানায়, তিন দিন গোলাগুলির শব্দ কানে আসেনি। তবে আশ্রয়শিবিরের পেছনে দূরের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। গুলির শব্দ কানে বাজছে। এর মধ্যে গত সোমবার রাত ১০টার দিকে হঠাৎ জেট ফাইটার থেকে গোলা ও বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
রোহিঙ্গা নেতাদের ধারণা, তিন দিন এই সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধ রেখে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে মিয়ানমার। ঘুমধুম ২ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু এলাকার ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ গোলাগুলির বিকট শব্দে তুমব্রুর ভূখণ্ড কাঁপছে। এতে এলাকার মানুষ ফের আতঙ্কে আছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সাথে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। চাষিরা মাঠে নামতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা পাঠের পরিবেশ হারাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছে। ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু এলাকার কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনী কোন সময় গুলি ছোড়ে, তার ঠিকঠিকানা নেই। তারা গুলি ছুড়লে জবাবদিহি করতে হয় না। তিন দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকায় ঘুমধুমের বেশ কিছু কৃষক চাষাবাদে মাঠে নামলেও শনিবার থেকে কারো নামা হবে না। সীমান্তে মাইন আতঙ্কেও ভুগছেন চাষিরা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ১৩ আগস্ট থেকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধ বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ২৭১ কিলোমিটার স্থল ও জলসীমানায় তৎপরতা বাড়াচ্ছে মিয়ানমার। তিন দিন ধরে সেন্টমার্টিনের বিপরীতে (পূর্ব দিকে) মিয়ানমার জলসীমানায় দেশটির তিনটি নৌবাহিনীর জাহাজ তৎপরতা শুরু করে। তবে সেন্টমার্টিন জলসীমানাতেও তৎপর আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পাহাড়ে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর যুদ্ধ পরিস্থিতি এপার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সীমান্তে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এপারে বিজিবি তৎপর রয়েছে ।
এ দিকে শুক্রবার বিকেলে শূন্যরেখার কাঁটাতারের কাছে গরু আনতে গিয়ে তুমব্রু এলাকার চাকমাপল্লীর এক তরুণ স্থল মাইন বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছেন। তার বাঁ পায়ের গোড়ালি আলাদা হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন।
বান্দরবান সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক
বান্দরবান ও উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার সেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা নিহত ও পাঁচজন আহত হওয়ার ঘটনার পর সেখানে এখন আতঙ্কাবস্থা বিরাজ করছে। বিজিবি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। টহলের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত বসবাসকারী লোকজনের যাতায়াত সীমিত করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে সীমান্ত লাগোয়া ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রটি নিরাপত্তার কারণে সেখান থেকে সরিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শনিবার সকালে কেন্দ্রের ৪৯৯ জন পরীক্ষার্থীকে গাড়িতে করে সেখান থেকে কুতুপালং পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ঘুমধুম কেন্দ্রের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের উখিয়ার কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে একাধিক বাসের ব্যবস্থা করেছে উখিয়া থানা ও কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ। উখিয়া থানা পুলিশ দুটি বাস ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অন্যান্য যানবাহনে করে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাসগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে উখিয়া থানার পুলিশ। ঘুমধুম থেকে কুতুপালং কেন্দ্রে পৌঁছতে বাসের সময় লাগে ৩৫ থেকে ৪৫ মিনিট।
উখিয়ার কুতুপালং কেন্দ্রে সহজে আসা-যাওয়ার জন্য কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের মরিচ্যা থেকে কুতুপালং পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার সড়ক যানজটমুক্ত রাখা হয়। শনিবার বেলা ১১টায় শুরু হয় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের আবারো বাসে করে ঘুমধুমে পৌঁছে দেয় পুলিশ।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জানিয়েছেন, সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পরীক্ষা কেন্দ্রটি দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং লোকজনদের নিরাপত্তায় সেখানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শনিবার রাত ৮টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের ৩৪ নং পিলারের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিক্ষেপ করা তিনটি গোলা এসে পড়ে। এগুলোর মধ্যে একটি বিস্ফোরিত হলে জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গা শিবিরের মোহাম্মদ ইকবাল (১৭) নামের এক যুবক মারা যায়। আহত হয় আরো পাঁচজন। রাতেই হতাহতদের উদ্ধার করে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গভীর রাত পর্যন্ত সীমান্তে গুলিবর্ষণ ও মর্টারসেল নিক্ষেপ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আতঙ্কে জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় নিলেও সকালে তারা আবার শিবিরে ফিরে গেছে। তবে পুরো তুমব্রু ও ধুম এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।