বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) পাশাপাশি রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসেবেও (ইআরকিউ) উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার জমা রেখেছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল কিনতে না চাইতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান পাওয়ার কারণে এই ডলার খরচে বরাবরই অনীহা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকটের সময়েও নিজেদের জমানো ডলার দিয়ে তেল কেনার খরচ মেটায়নি বিপিসি। উল্টো তেল আমদানিতে ডলার দিয়ে ব্যাংকগুলো সহযোগিতা করছে না মর্মে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ কমাতে ও বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রপ্তানিকারকের ইআরকিউ হিসেবে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার ৫০ শতাংশ অনতিবিলম্বে নগদায়নের নির্দেশনা দেওয়ার পর বেরিয়ে আসে বিপিসির জমিয়ে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার তথ্য। এর পরই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপিসিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, নিজেদের ইআরকিউ হিসাবে ডলার অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় তাদের আর কোনো আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে সহযোগিতা করা হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন কঠোর অবস্থানের পর ইআরকিউ হিসাবের ডলার দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানির এলসির মূল্য পরিশোধ করছে বিপিসি।
জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ শাখায় বিপিসির এই ইআরকিউ হিসাব পরিচালনা করা হচ্ছে। এই হিসাবে একশ মিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষিত ছিল। এ বিষয়ে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণি লাল দাশ আমাদের সময়কে বলেন, ইআরকিউ হিসাবের ডলার দিয়ে এরই মধ্যে তিনটি আমদানি এলসির মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে ইআরকিউ হিসাবে ৫০ লাখ ডলার রয়েছে। এটি রাখা হয়েছে আইটিএফসির বিভিন্ন টুকটাক পেমেন্টের জন্য। ইআরকিউ হিসাবের ডলার আগে কেন খরচ করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ডলার আপৎকালীন সময়ের জন্য রক্ষিত ছিল, এ জন্য খরচ করা হয়নি। এখন সেই আপৎকাল চলছে, যা এখনো শেষ হয়নি। ইআরকিউ হিসাবে রক্ষিত এই অর্থ বিপিসির এক সময়ের রপ্তানি আয় থেকে সংরক্ষণ করা ছিল বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রত্যাবসিত রপ্তানি আয়ের নির্দিষ্ট অংশ ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখা যায়। স্থানীয় মূল্য সংযোজনের মাত্রা অনুযায়ী রিটেনশন কোটার হার ১৫ শতাংশ কিংবা ৬০ শতাংশ হতে পারে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই হার ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনায় রিটেনশন কোটা হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা জমার মাত্রা কমিয়ে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫০, ৩০ ও ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অভিযোগ উঠেছে, বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে এই নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তা মানতে কালক্ষেপণ করছে।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নগদায়ন না করতে তোলা হচ্ছে নানা অজুহাত। এরই মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের বৈদেশিক মুদ্রা নগদায়ন না করার অনুমতি চেয়ে নিজ ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠিও পাঠিয়েছে। চিঠিতে তারা সুদবাহি মেয়াদি হিসাব পরিচালনা, ভবিষ্যৎ আমদানি দায় পরিশোধ ও ইরআরকিউ হিসাবের স্থিতি লিয়েন রেখে আন্তর্জাতিক কার্ড ইস্যু করার যুক্তি তুলে ধরেছে। তবে বিপিসি এ ধরনের কোনো যুক্তি না তুললেও প্রথম দফায় ইআরকিউ হিসাবে রক্ষিত অর্থের ৫০ শতাংশ ডলার দিয়ে নিজেদের আমদানি এলসির মূল্য পরিশোধের অনুমতি চেয়ে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছিল। ওই আবেদনের পরই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপিসিকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, নিজের ইআরকিউ হিসাবে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত তাদের জ্বালানি তেল আমদানিতে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার দেওয়া হবে না।
জানা যায়, সর্বশেষ গত ১১ আগস্ট সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভাইটল এশিয়া পিটিই সরবরাহকৃত অকটেনের মূল্য বাবদ ২ কোটি ৯০ লাখ ৮১ হাজার ৬৯২ টাকার এলসি মূল্য পরিশোধের জন্য সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করে বিপিসি। এর পর ওই শাখা থেকে বিপিসির চিঠির অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। বিপিসির ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক ইআরকিউ হিসাব হতে গত ৩ আগস্ট ইন্দোনেশিয়াভিত্তিক পিটি বুমি সিয়াক পুসাকো যাপিন হতে সবরাহকৃত ফার্নেস অয়েলের মূল্য বাবদ ১ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ১২৫ টাকা পরিশোধে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে গত ১০ আগস্ট ইআরকিউ হিসাবে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৮১ হাজার ৬৯২ টাকা জমা রয়েছে। এই টাকা থেকে গত ১১ আগস্ট সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভাইটল এশিয়া পিটিই সরবরাহকৃত অকটেনের মূল্য বাবদ ২ কোটি ৯০ লাখ ৮১ হাজার ৬৯২ টাকার এলসি মূল্য পরিশোধের আবেদন জানানো হয়। এই মূল্য পরিশোধ কার্যকর হলেই বিপিসির ইআরকিউ হিসাবে অবশিষ্ট থাকবে মাত্র ৫০ লাখ ডলার।
এর আগে গত মাসের শেষ দিকে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলার মূল্যের এলসির মূল্য পরিশোধে ইআরকিউ হিসাবের অর্থ ব্যবহার করার জন্য সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছিল বিপিসি।