ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারের সুফল এখনও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এপ্রিলে এসব সুবিধা নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানি করেছেন বড় মিল মালিক ও আমদানিকারকরা। যা ইতোমধ্যে দেশের বাজারে চলে এসেছে। পাশাপাশি তিন মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলে দাম কমেছে ১৭৫ ডলার। তারপরও দেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। বরং ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে এক মাসে দুদফায় প্রতি লিটার সয়াবিনে দাম বাড়িয়েছেন ৫১ টাকা। ভোক্তার পকেট কেটে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল ১৩৮৫ ডলার। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে একপর্যায়ে তা বেড়ে যায়। মার্চে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় ১৯৫৬ ডলার। এপ্রিলে কমে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় ১৯৪৭ ডলার। আর বর্তমানে টনপ্রতি ১৭৮১ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলে দাম কমেছে ১৭৫ ডলার।
এদিকে ২ জুন সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। এখন দেশের বাজারেও তা কমবে। মে মাসের তথ্য পর্যালোচনা করা হবে। সুখবর হচ্ছে, পাম তেলের দাম কমেছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে-সয়াবিনের দামও কমার দিকে। আমার ধারণা, দাম বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই।
তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের ৬ দিন পর ৯ জুন সর্বশেষ নতুন করে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল সর্বোচ্চ ৭ টাকা বাড়িয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন দাম কার্যকর করেছে। এ সময় বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ২০৫ ও খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮৫ টাকা ধরা হয়েছে। এর আগে ৫ মে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই ভাবে খোলা তেলের দাম প্রতি লিটার ধরা হয়েছে ১৮০ টাকা। যা গত ২০ মার্চের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে খোলা তেল প্রতি লিটারে ৪৪ টাকা এবং বোতলজাত তেলের দাম বাড়ানো হয় ৩৮ টাকা বেশি।
জানতে চাইলে কনজ্যুমাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানি কারা তেল দেশের বাজারে আসলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, কিন্তু দেশে বাড়ানো হচ্ছে। তাই এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যাতে করে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে দাম খুব একটা কমেনি। যদি সামান্য কিছু কমেছে আমদানিতে তার প্রভাব এখনই পড়বে না। কারণ দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া এই দামের সঙ্গে জাহাজ ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হয়। তবে ভোজ্যতেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে এলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দেশের বাজারে দাম পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে সরকারের দাম বৃদ্ধির পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম পাঁচবার উঠানামা করে। এর মধ্যে তিন দফায় দাম বেড়েছে, কমেছে একবার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারসাজিতে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে বেসামাল হয় ভোজ্যতেলের বাজার। ফলে অক্টোবরে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন লিটার ১৬০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটার ২১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সে সময় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সে সময়ও বেঁধে দেওয়া দামে তেল পাওয়া যায়নি।
পরে দাম কমাতে সরকারের পক্ষ থেকেও নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রোজা ও ঈদ উপলক্ষ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। এর আগে এলসি কমিশন ও মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়। এরপরও সরকার ২০ মার্চ তেলের দাম প্রতি লিটার ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু ওই দরে বাজারে তেল পাওয়া যায় না। বিক্রি হয় ১৮০ টাকার উপরে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজারে অভিযান চালিয়ে বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পায়।