তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ গরম তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতুতে। সেখানকার কালীগঞ্জ উপজেলার ৬ নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউপিতে নৌকা ও আওয়ামী লীগের জাদরেল দুই প্রার্থী নজরুল ইসলাম ছানা ও মাহবুবুর রহমানকে কুপোকাত করে চেয়ারম্যান হয়েছেন হিজড়া ঋতু। জনপ্রতিনিধির তালিকায় তৃতীয় লিঙ্গের দ্বিতীয়জন তিনি। এর আগে তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম জনপ্রতিনিধিও হন ঝিনাইদহে।
গত বছর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলায় নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান সাদিয়া আখতার পিংকীও তৃতীয় লিঙ্গের। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন তিনি। পিংকীর আবদার ছিল তাকে যেন হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ না বলে মানুষ বিবেচনা করা হয়। আবদারটি কদর পায়নি। কাজকর্মে ভালোই করছিলেন পিংকী। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আরেক হিজড়া লাবলী ওরফে আক্তারুলকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হন পিংকী। ওই মামলায় আরও পাঁচ হিজড়াকে আসামি করা হয়।
পিংকী-ঋতুদের জীবন বড় বেদনার। কঠিন বাস্তবতায় মানুষকে জ্বালান। জ্বলেন নিজেরাও। জন্মের পর তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় ৭ বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে আসেন রোববার জেতা ইউপি চেয়ারম্যান ঋতু। বড় হন ডেমরায় হিজড়া দলের গুরুমার কাছে। তার বয়স এখন ৪৩। ঢাকায় থাকলেও পরিবারের টানে প্রায়ই বাড়িতে যেতেন ঋতু। নিজের জমানো অর্থ দিয়ে প্রায় ১৫ বছর ধরে জন্মস্থান দাদপুর গ্রামসহ ইউনিয়নের উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতা করে আসছেন। এ পর্যন্ত তার এলাকায় দুটি মসজিদ করেছেন। স্থানীয়দের যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে যান, সমাধান করেন। প্রশংসা পান। হিজড়া বলে গালমন্দসহ তাচ্ছিল্যও হজম করেন।
সরকারের দিক থেকে তৃতীয় লিঙ্গকে তাচ্ছিল্য না করে মর্যাদা দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সদিচ্ছাও আছে। গেলবার জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে একজনকে এমপি করার একটি আওয়াজও ছিল সরকারি দলে। সেই আশায় ফরম কিনেছিলেন রংপুরের নাদিরা, ময়মনসিংহের আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী, চট্টগ্রামের ফাল্গুনীরা। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে তৃতীয় লিঙ্গকে মর্যাদা দেওয়ার একটা তাগিদ তৈরি হয়েছে দেশে। দেশের ইতিহাসে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) নারী হিসেবে টেলিভিশনে প্রথমবারের মতো বৈশাখী টিভিতে সংবাদ পাঠ করানো হয়েছে তাসনুভা আনানকে দিয়ে। যদিও ওই বিষয়ক ফলো আপ আর নেই।
তৃতীয় লিঙ্গের বেড়ে ওঠা এবং বিচ্ছিন্ন কিছু খবরের মধ্যে বিশ্লেষণের প্রচুর খোরাক। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রথমবারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের নিজের পরিচয় ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গকে। এর নেপথ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশ। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের আইনি এবং রাষ্ট্রীয় অধিকারের একটি স্বীকৃতি। এর বিপরীতে হিজড়াদের উৎপাতে মানুষের বিরক্তির চিত্র নিত্যদিন। তৃতীয় লিঙ্গের হয়রানি থেকে বাঁচতে পুলিশের কাছে মানুষের আবেদন পড়ে নিয়মিত। কেবল রাস্তায় নয়, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসে ওঠে যাত্রীদের হেনস্তার মাত্রা দিনকে দিন কেবল বাড়ছে। বিশেষ করে পথচারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, নবজাতক ও শিশুদের জিম্মি করে অভিভাবকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা বাগানো, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনক।
তাদের পেছনে অপরাধী চক্রের কারসাজি প্রকাশ পাচ্ছে মাঝেমধ্যে। এদেরকে দিয়ে নানা মন্দ কাজ করানো হচ্ছে। রাজধানীর খিলক্ষেতে তৃতীয় লিঙ্গের সেলিম ওরফে বৃষ্টি, মিরপুরে কোকিলা, জামালপুরে হায়দার আলী হত্যাসহ কিছু ঘটনার নিবিড় তদন্ত হলে নেপথ্যের অনেক রহস্য বেরিয়ে আসতে পারতো। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অপরাধ কমাতে হলে তাদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার। ভালো কাজের স্বীকৃতি বা পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হলে এ তৃতীয়দের মধ্য থেকে ঋতু, পিংকী, তাসনুভা বেরিয়ে আসতে পারে। নইলে বৃষ্টি-কোকিলার ভাগ্যবরণও হতে পারে।
এ রকম সময়ে মন্দের ভালো খবর যোগ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। বিএসএমএমইউতে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের চিকিৎসার জন্য ডিসঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট বহির্বিভাগ ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। মূলত তৃতীয় লিঙ্গসহ অপূর্ণাঙ্গ বা ক্রটিপূর্ণ লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের শারীরিক ফেনোটাইপ (বাইরের প্রজনন অঙ্গ) ও জেনোটাইপ (জিনগত ভিতরের প্রজনন অঙ্গ) অনুযায়ী সার্জারিসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ লিঙ্গে রূপ দিতে এ ক্লিনিকটি চালু করা হলো।
এটাকে রূপান্তরিত লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারও বলা হয়। ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, শিশুকালেই এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। উদ্যোগটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সরকারের এ সংক্রান্ত একটি অঙ্গীকারও রয়েছে। ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, শূন্যের কোটায় আসবে থার্ড জেন্ডার’-এ প্রতিপাদ্য বাস্তবায়ন হলে তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি মোটাদাগের ঘটনা দেখবে বিশ্ব।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন