চাদর বা অন্য কোনো শীতের পোশাক নেই শরীরে। বয়সের কারণে হালকা বাতাসেই বসে কাঁপছিলেন নোয়াখালী জেলার সদর থানার হারিচৌধুরী ইউনিয়নের চরজব্বার গ্রামের ৮০ বছর বয়সী সিরাজুল হক। এলাকাবাসী ভালোবেসে ডাকেন ‘জিয়া হুত’ বলে। নোয়াখালীর ভাষায় ‘জিয়ার হুত’ বলতে জিয়ার ছেলে বুঝানো হয়।
ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশে তাই সুদূর নোয়াখালী থেকে পাঁচ দিন আগেই চলে এসেছেন ঢাকায়। ঢাকায় আত্মীয়স্বজন না থাকায় ভালোবাসার দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আশ্রয় নেন।
ঠাণ্ডায় পাতলা পাঞ্জাবি ছাড়া শীতের পোশাক পরিধান না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ঢাহায় কেউ নাই, একজন ঢাহায় আইতেছিল হের হিছু ধইরা চইলা আইছি। হাটি অহিসে তিন দিন ছিলাম। যে দিন হুলিশ আক্রমণ চালায় তখন ব্যাগ অহিসের রায়হা আমি গলির পাশে মসজিদে গেছিলাম। ব্যাগে আমার শার্ট, চাদর, কমল সবকিছু ছিল। হরে হুলিশ অহিসের বিতরথে ব্যাগ আনতে দেয় নাই।’
কিভাবে বিএনপি দলের প্রতি ভালোবাসা জানতে চাইলে বলেন, ‘আয় ছোটকাল থে হুকটি মাছের ব্যবসা করি। চট্টগামে হুকটি কিনতে গিয়ে হুনি জিয়াউর রহমান মাটি কারতে আয়ছে এখানে।’ সেদিন জিয়াউর রহমানকে মাত্র ৮ থেকে ১০ হাত দূর থেকে দেখেছেন তিনি। জিয়াউর রহমানের মাটি কাটার ধরণ তাকে ওই দিন মুগ্ধ করেছিল। এখনো সে স্মৃতি মনে হলে নিজের অজান্তেই ভালো লাগায় হেসে ওঠেন।
তার ভাষ্যমতে, ‘যহন জিয়া মাটিতে কোদালের কোপ দিল তখন এক কোপে ওয়া (অনেক মাটি একসাথে পড়া) হরি গেছে। বলেই দাঁড়িয়ে দেখাতে লাগলেন।’
জিয়াউর রহমানকে সরাসরি দেখার পর থেকে পিএনপির প্রতি তার গভীর ভালোবাসা। বলা চলে নাড়ির সম্পর্কের মতো। সেই থেকে তিনি বিএনপির কোনো প্রোগ্রাম জানলে ভুলেও বাদ দেন না।
খালেদা জিয়াকেও সিরাজুল হক সরাসরি দেখেছেন। বললেন, নোয়াখালীর চরজব্বারে যখন খালেদা জিয়া গিয়েছিলেন তাকেও তিনি মঞ্চের কাছে থেকে দেখেছিলেন।
দীর্ঘ দিন পর বিএনপি ঘোষিত বিভাগীয় গণসমাবেশের প্রায় সবগুলোতেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। কুমিল্লা বা অন্য জেলায় যেতে সমস্যা না হলেও খুলনায় গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় সিরাজুল হককে। শুঁটকি বিক্রি করে চলে তার সংসার। চার মেয়ের তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আর এক মেয়েকে টাকার জন্য বিয়ে দিতে পারছেন না বলে জানান। ওই সামান্য আয়ের পকেটে থাকা তিন হাজার এক শ’ টাকা নিয়ে নোয়াখালী সোনাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে জানতে পারেন টিকিটের দাম তিন হাজার টাকা। দলের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকলে যা হয়, কোনো কিছু না ভেবেই ওই টাকায় টিকিট কেটে চলে আসেন খুলনা সমাবেশে। না খেয়েই সমাবেশস্থলেই রাত কাটান তিনি। এরপর চা পান করে চট্টগ্রামের সমাবেশের কথা বলতে শুরু করেন।
চট্টগ্রামে বিএনপির সমাবেশের আগের দিন পকেটে থাকা এক হাজার আট শ’ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সমাবেশের উদ্দেশে। তিন শ’ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে একায় চলে আসেন সমাবেশস্থলে। অবশ্য এদিন তাকে আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়নি। পাশেই একমাত্র ছোট বোনের বাসা সেখানে কোনোমতো ফজর পর্যন্ত কাটিয়ে মঞ্চের পাশে অবস্থান নেন। সমাবেশ শেষে কারো জন্য অপেক্ষা না করে টিকিট কেটে বাড়ি চলে আসেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে তিনি বাবা এবং খালেদা জিয়াকে মায়ের মতো ভালোবাসেন। এর প্রতিদানে কিছু না পেলেও একরোখা ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে এলাকায় অনেকের গাল-মন্দসহ হুমকির শিকার হয়েছেন। তবু কমেনি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা। তিনি কোনো প্রতিদান চান না, চান শুধু খালেদা জিয়া আবার মঞ্চে কথা বলুক। তারেক জিয়া তার বাবার মতো দলকে পরিচালনা করুক।