অন্য ভাষায় :
শনিবার, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।
শিরোনাম :

মুখ বাঁকা ও চোখ বন্ধ না হওয়া রোগ

ডা. মিল্টন রায়
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ৮৩ বার পঠিত

আমাদের মস্তিষ্কে ১২ জোড়া ক্রেনিয়াল স্নায়ুর প্রতিটির একটি নির্দিষ্ট কাজ আছে। কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে ক্রেনিয়াল স্নায়ু শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। ১২ জোড়া স্নায়ুর মধ্যে ২ নং স্নায়ু চোখে দেখার ক্ষেত্রে কাজ করে। ৩ থেকে ৭ নম্বর ক্রেনিয়াল স্নায়ু চোখ এবং মুখের মাংসপেশির কার্যকারিতার সাথে জড়িত।

ওকুলোমটর স্নায়ু চোখের পলক পড়া এবং নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। ট্রোক্লিয়ার স্নায়ু চোখের সামনে-পেছনে ও উপর-নিচ করা নিয়ন্ত্রণ করে। ট্রাইজেমিনাল স্নায়ু মুখ এবং গাল, স্বাদ এবং চোয়ালের নড়াচড়ায় সংবেদন বজায় রাখে। আবডুসেন্স স্নায়ু চোখ নাড়ানোর ক্ষমতা বজায় রাখে। ফেসিয়াল স্নায়ু মুখের অভিব্যক্তি এবং স্বাদ অনুভ‚তি নিয়ন্ত্রণ করে। কনট্রাল্যাটারাল সুপারনিউক্লিয়ার ক্ষত হলে মুখের এক পাশে সমস্যা হয় কিন্তু চোখ স্বাভাবিক থাকে।

ইপসিল্যাটারাল নিউক্লিয়ার অথবা ইনফ্রানিউক্লিয়ার ক্ষত হলে মুখের এক পার্শ্বে ও একই পাশের চোখে সমস্যা হয়। দ্বিপার্শ্বিক নিউক্লিয়ার ক্ষত কিংবা দ্বিপার্শ্বিক ইনফ্রানিউক্লিয়ার ক্ষত হলে মুখের দুই পাশে ও চোখের দুই পাশে সমস্যা হয়। একই পাশের মুখের ও চোখের সমস্যাকে আমরা সাধারণত বেলস পালসি নামক ব্যাধি বলে থাকি। বেলস পলসি হলো মুখের সাম্প্রতিক পক্ষাঘাত যা মুখের গর্তের মধ্যে বা স্টাইলোমাস্টয়েড ফোরামেনে মুখের স্নায়ুর প্রদাহ এবং ফোলা। এটি সাধারণত একপার্শ্বিক হয়, খুবই কম পরিমানে দ্বিপার্শ্বিক হয়। এবং পুনরাবৃত্তিও হতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে, পারিবারিক ইতিহাসও থাকে। মূল কারণ অনিশ্চিত, তবে ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হতে পারে, যেমন হারপিস সিমপ্লেক্স।, ভাইরাল ইনফেকশন, মধ্য কর্ণে ইনফেকশন, ঠাণ্ডাজনিত কারণে (অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ফ্রিজের পানি, শীতের সময় মোটরসাইকেল চালানো, শীতের মধ্যে পানিতে নেমে সারা রাত মাছ ধরা ইত্যাদি), আঘাতজনিত কারণে, মস্তিষ্কের স্ট্রোকজনিত কারণে, কানের অপারেশন পরবর্তী ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি ইত্যাদি কারণেও হতে পারে। বেলস পালসির মহামারী বিক্ষিপ্তভাবে ঘটে। এর সাথে স্ট্রোকের মিল থাকলেও দুটো আলাদা। স্ট্রোক হলে শরীরের যেকোনো একটা দিক পুরোটা আক্রান্ত হয়, অর্থাৎ হাত-পা সব অবশ হয়ে আসে। বেলস পালসির ক্ষেত্রে শুধু চোখ ও মুখের এক পাশ আক্রান্ত হয়।

পরীক্ষা : সিটি স্ক্যান, কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, এক্সরে অব টেম্পরো-মেন্ডিবুলার জয়েন্ট, ইএমজি, নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি ইত্যাদি।

উপসর্গ : স্বাদের দুর্বলতা, কানে সাধারণ শব্দ সহ্য করতে পারা যায় না এবং লালা প্রদাহ হতে পারে এবং আরো গুরুতর হতে পারে। চোখ দিয়ে পানি পড়া কমই হয়। কুলি করতে গেলে অন্য পাশে চলে যায় বা পড়ে যায়। খাবার গিলতে কষ্ট হয়। কপাল ভাঁজ করতে বা ভ্রূ কুঁচকাতে পারে না। অনেকসময় কথা বলতে কষ্ট হয়। পানি পান করতে কষ্ট হয়। চোখ বন্ধ করে দাঁত দেখানোর চেষ্টা করার সময় এক চোখ বন্ধ হয় না এবং চোখের গোলা উপরের দিকে এবং বাইরের দিকে ঘোরে- বেলস পালসি (চোখ বন্ধ করার সময় চোখের গোলার স্বাভাবিক গতিবিধি থাকে)।

চিকিৎসা : কানের পেছনে ব্যথার তীব্রতার কারণে মুখের দুর্বলতা দেখা যায়, যা ৪৮ ঘণ্টার সময় ধরে বিকাশ লাভ করে। ৪৮ ঘণ্টা থেকেই সারতে শুরু করে এই রোগ। অধিকাংশ মানুষের দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। কারো কারো দু থেকে ছয় মাস অবধি সময় লাগে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে সারবেই। এই রোগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা যায়।

কোনো কোনো চক্ষু বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে মেকোবালামাইন, ভিটামিন বি১-বি৬-বি১২, মকসিফ্লোকজাসিন চোখের ড্রপ, টোব্রামাইসিন চোখের ওয়েইনমেন্ট ব্যবহার করতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্নায়ু রোগ কিংবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ফিজিশিয়ানদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাল এজেন্ট (অ্যাসাইক্লোভির) এর সহিত প্রেডনিসোলনও ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই তাদের দেয়া এন্টিবায়োটিক কিংবা স্টেরয়েডের সাথে ফিজিওচিকিৎসা নিতে পরামর্শ প্রদান করেন।

ফিজিও চিকিৎসা/থেরাপি : স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ফিজিওথেরাপিস্টরা দুইভাবে চিকিৎসা প্রদান করেন। ১) ইলেকট্রোথেরাপি/মেকানিকাল থেরাপি ২) ম্যানুয়াল থেরাপি (ব্যায়াম চিকিৎসা)।

ইলেকট্রোথেরাপি : ক্রেয়েনিয়াল স্নায়ু ০৭ (মুখের স্নায়ু) রুটকে উত্তেজিত করতে হবে। ইলেট্রিক্যাল স্নায়ু স্টিমুলেশন ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, রোগী যেন ভয় না পেয়ে যায়। যারা গর্ভবতী তাদের ক্ষেত্রে স্টিমুলেশন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু ঠাণ্ডার কারণে হতে পারে তাই গরম পানির ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। লুমিনুয়াস ইনফ্রা রেড রেডিয়েশন ব্যবহার করা যেতে পারে। মুখ যদি ফোলা থাকে তাহলে শুধু স্নায়ুর স্টিমুলেশনই ভালো। স্নায়ুর ট্রান্সকিউটানিওয়াস স্টিমুলেশন সাধারণত অ্যাসিমেট্রিক্যাল, অ্যাসিমেট্রিক্যাল অল্টারনেটিং, বারস্ট অ্যাসিমেট্রিক্যাল, বারস্ট অ্যাসিমেট্রিক্যাল অল্টারনেটিং, সিমেট্রিক্যাল হয়ে থাকে। অনেক ফিজিওথেরাপিস্ট বৈদ্যুতিক কিংবা ব্যাটারিচালিত স্টিমুলেশনের ক্ষেত্রে কলম আকৃতির ইলেকট্রোড ব্যবহার করে থাকেন।

ব্যায়াম চিকিৎসা : ঘুমের সময় উন্মুক্ত চোখকে রক্ষা করার জন্য চশমা ব্যবহার করেন। মুখের মাংসপেশির সেনসরি ইনট্রিগেশন টেকনিকে ব্যায়াম করাতে হবে। ব্রাশ ও আইসক্রিমের কাঠির ব্যায়াম করাতে হবে।

সফট টিস্যু মোবিলাইজেশন ব্যায়াম করাতে হবে মুখের মাংসপেশির ও চোখের মাংসপেশির। এ ছাড়া বাড়িতে করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করার পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে। যেমন : ১) মুখের মধ্যে চুইংগাম রেখে চিবাতে হবে। ডাইবেটিস থাকলে চুইংগাম রাখা যাবে না। তখন সুপারি রাখা যেতে পারে। সুপারিতে অনেকের মাথা ঘোরায়, মাথা ঘোরালে ওটা বাদ দিয়ে মুখের মধ্যে হরীতকী রাখা যেতে পারে। ২) বাঁশি/ মাউথ অর্গান বাজাতে হবে। ৩) শিশুদের জন্মদিনের বেলুন ফোলাতে হবে সকালে ও বিকেলে। ৪) বাসার মধ্যে শিস দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। ৫) মোমবাতি জ্বালিয়ে ফুঁ দিয়ে নেভাতে হবে, ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়াতে হবে। ৬) টোস্ট বিস্কুট চিবাতে হবে। ৭) গরম ভাত ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে। ৮) বাংলা স্বরবর্ণ ও ইংরেজি ভাউয়েলগুলো বারংবার বলতে হবে। ৯) প্লেটে তরলজাতীয় খাবার দিয়ে চেটে চেটে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ১০) ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার যেমন আইসক্রিম, ফ্রিজের পানীয় ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। ১১) কুসুম গরম পানি গার্গল করতে হবে। ১২) আঙুল দিয়ে বারংবার চোখের পাতা বন্ধ করে দিতে হবে। ১৩) চোখে কালো চশমা ব্যবহার করতে হবে। ইত্যাদি ব্যায়ামগুলো রোগীর নিজেকে করতে হবে।

লেখক : নিউরো ফিজিওথেরাপিস্ট ও জেরোন্টোলজিস্ট (প্রবীণ ও বার্ধক্যবিদ)

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com