সোমবার, ০১:৩৪ অপরাহ্ন, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

বেগম খালেদা জিয়া: আপসহীনতায় পেয়েছেন অভিভাবকের আসন

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫
  • ৩ বার পঠিত

১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। রাজধানী থেকে দুই শিশুসন্তানসহ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হলে গৃহবধূ থেকে রাজপথের সক্রিয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন উপাধি পান। গণতন্ত্রের প্রশ্নে যিনি ছিলেন সবসময় আপসহীন। দলমত নির্বিশেষে সবাই যাঁকে অভিভাবক মানেন। যাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবেÑ তিনি বেগম খালেদা জিয়া। সেই মানুষটি রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালের সিসিউতে জীবন সংগ্রামে লড়াই করছেন। সম্প্রতি তাঁর জন্য দোয়া চাইতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন- গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই সময়ে খালেদা জিয়া জাতির জন্য ভীষণ রকম অনুপ্রেরণা। তাঁর সুস্বাস্থ্য দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম ও গণতন্ত্রের প্রতি আপসহীন অবস্থান প্রশ্নাতীত। এ ছাড়া খালেদা জিয়া এমন একজন গণতান্ত্রিক নেতা, যাঁর রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব এখন প্রতিষ্ঠিত। যিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসেন এবং দেশের মঙ্গলের জন্যই সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন। এই ত্যাগ স্বীকার করতে গিয়ে ফ্যাসিস্ট শাসকদের হাতে তাঁকে বারবার চরমভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছে। এতে তিনি অসুস্থ

হয়েছেন এবং তাঁর জীবন বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এটি একজন রাজনৈতিক অভিভাবকের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।

মাহবুব উল্লাহ বলেন, জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর খালেদা জিয়া দেশের রাজনীতিতে একজন দিশারির ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের একজন মুরব্বি ও অভিভাবক হিসেবে তাঁর নীরব, নিঃশব্দ অনেক ভূমিকা দৃশ্যমান। মূলত তাঁর উপস্থিতিই কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের জন্য বড় অনুপ্রেরণার শক্তি। তাঁর এই অভিভাবকত্বকে সব রাজনৈতিক দল শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। এই অভিভাবক সুলভ চরিত্র তাঁকে আজীবন অমর করে রাখবে। এরই মধ্যে ইতিহাসে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল স্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে।

খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবরে বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা খুবই উদ্বিগ্ন। অনেকেই ছুটে গেছেন হাসপাতালে। রাজনীতির ইতিহাসের অংশ বেগম খালেদা জিয়া; তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতির খবর শোনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখলে মনে হচ্ছে খালেদা জিয়ার কষ্টে নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র চলছে প্রিয় মানুষটির জন্য প্রার্থনা।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে ত্যাগ, যে আপসহীন সংগ্রাম তাঁর ধারে কাছেও বর্তমান সময়ে অন্য কেউ নেই। এই মুহূর্তে জাতির অভিভাবকের আসনে বেগম খালেদা জিয়া।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যখন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে (সেনানিবাস) বাসায় তাঁর দুই শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে ছিলেন। ওই সময় অষ্টম বেঙ্গলের সেনারা চলে এসে বলেছিল, ‘পাকিস্তানি সেনারা বলছেÑ অস্ত্র সমর্পণ করতে। আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব কি না?’ সেদিন বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘তোমাদের অধিনায়ক মেজর জিয়ার নির্দেশ ছাড়া তোমরা কোনো অস্ত্র সমর্পণ করবে না।’ সেই দিন থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই দুই শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়া। ঢাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দেশ স্বাধীন হলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ মুক্তজীবনে ফেরেন খালেদা জিয়া। তাঁর এই অবদান প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো শিশু মুক্তিযোদ্ধা।’ ১৯৮১ সালের ৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশুসন্তান নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন তিনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বিপর্যস্ত এবং দিশাহারা। জিয়াউর রহমান পরবর্তী দলের হাল কে ধরবেন, সেটি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে। বিএনপি নেতারা তখন দ্বিধাগ্রস্ত এবং তাঁদের মধ্যে কোন্দলও ছিল প্রবল।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সাত্তারের বয়স তখন ৭৮ বছর। তখনকার রাজনীতিতে সাত্তারকে একজন বৃদ্ধ এবং দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো। তৎকালীন সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাত্তারকে পছন্দ করতেন।

যদিও জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন, তখন খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যেত না। খালেদা জিয়া যখন রাজনীতিতে আসেন সেটা অনেককে চমকে দিয়েছিল। খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম এবং একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এ ছাড়া নজরুল ইসলাম খান এবং জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ তরুণ নেতাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে গিয়ে প্রথম রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেন।

এর আগে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বার্ধক্য, অসুস্থ সাত্তার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান থাকলেও দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। এর কয়েক মাস পরই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন তিনি। খালেদা জিয়া যদি তখন বিএনপির হাল না ধরতেন, তাহলে বিএনপি নিঃসন্দেহে গভীর সংকটে পতিত হতো বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছিল, তখন বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল থেকে খালেদা জিয়াকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। খালেদা জিয়া সবার মতামত গ্রহণ করে রাজপথের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন। আশির দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে ওঠে।

ওই সময় তিনি আপসহীন দেশনেত্রী উপাধিতে ভূষিত হন রাজনৈতিক অঙ্গনে। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ দুই দফা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। শেষবারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে খালেদা জিয়াসহ দেশের বহু রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়। যদিও এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অভিযোগ আছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে নানা কলাকৌশল ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন চালায় শেখ হাসিনা সরকার। নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিসহ দেশের সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের পর একতরফা নির্বাচনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে নির্বাচনে আগে ভিত্তিহীন মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করা হয়। এই নির্বাচনে অংশ নিলেও আগের রাতে ভোট করায় ফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও বিএনপিসহ মিত্র দলগুলো বর্জন করে। এরপর শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলন সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া মুক্তজীবনে ফিরে আসেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরের দিন তিনি দেশবাসীকে প্রতিহিংসা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। খালেদা জিয়ার আপসহীন ত্যাগ ছাত্র-জনতাকে অনুপ্রাণীত করেছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে খালেদা জিয়ার আপসহীন চরিত্র সবাইকে অনুপ্রাণীত করেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com