তুলনার কথাটি যখন এসেই পড়ল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির একটি তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধকালে অবকাঠামোগত ধ্বংস ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি পিছিয়ে থাকলেও সম্প্রতি দেশটির প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তানের হারকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নির্দেশকগুলোতে বাংলাদেশ যে ব্যাপক উন্নতি করেছে, তাতে একসময় এগিয়ে থাকা পাকিস্তান পিছিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর এবং অসাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদবিরোধী অবস্থানের বিপরীতে পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের উত্থান ও গণতন্ত্রের জায়গায় সামরিকতন্ত্রের প্রভাবের কথা আপাতত না-ই বা বলা হলো। সুতরাং যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছিল এই বলে যে পাকিস্তান ছেড়ে এলে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে, তাদের জন্য বাংলাদেশের তুলনামূলক ভালো অর্জন বুক চাপড়ানো উন্নয়ন-ধাঁধা হিসেবে থাকছে বলে মনে হয়। ভারতের বিপক্ষেও অর্জন অনেক আশাব্যঞ্জক। স্বয়ং নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মাথাপিছু আয়ের পার্থক্যটা ক্রমেই কমতির দিকে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটে এবং জনগণের স্ফীত প্রত্যাশা সামনে রেখে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। গেল এক বছরে সরকারের সাফল্যের ঝুড়িতে বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রশংসা কুড়িয়েছে; যেমন—ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ, বৈদেশিক মুদ্রার মান সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা ইত্যাদি। কিন্তু বিষম রকমের অভিযোগ আছে যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশেষত মব সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এই ব্যর্থতা ঢাকতে নানা গল্প শোনানো হচ্ছে। কলকারখানায় হামলা, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ব্যবসায়ীদের প্রতি হুমকি ইত্যাদি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এমতাবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা যাওয়া উচিত বলে ধারণা অভিজ্ঞমহলের। সন্দেহ নেই যে রোল মডেল স্ট্যাটাস থেকে বাংলাদেশ এখন বহু দূরে। তাই আশু করণীয় হচ্ছে, চটজলদি নির্বাচন কমিশন সংস্কারের মাধ্যমে ঘোষিত সময়ে দেশে নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক, কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত একটি ন্যায়সংগত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। আমরা চাই না যে বাংলাদেশ পরিচিত হক প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার রোল মডেল হিসেবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়