বুধবার, ০৫:১৬ অপরাহ্ন, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

আবার ভাঙনের মুখে জাতীয় পার্টি

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫
  • ৬ বার পঠিত

দেশে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা জোরালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতীতের মতোই জাতীয় পার্টিতে (জাপা) সংকট শুরু হয়েছে। দলীয় কাউন্সিল ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ নেতৃত্ব বদলের ফলে এই সংকট আরও প্রখর হতে দেখা গেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর কঠিন সময়ে দলের শীর্ষ নেতারা একতাবদ্ধ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে বর্তমানে দলে দ্বিধাবিভক্তি দৃশ্যমান হয়েছে। গত পরশু হঠাৎ করে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে একদিকে মহাসচিব বদল, অন্যদিকে তিন সিনিয়র নেতাকে অব্যাহতির ঘটনায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন, দল যখন নানামুখী চাপে, তখন এ রকম সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ছাড়া কিছু নয়।

এদিকে গতকাল অব্যাহতি পাওয়া নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন, দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত নয়, তারা এখনও স্বপদে বহাল আছেন। নিজেদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দাবি করে দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তগুলোকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনে জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের দাবি জানান তারা।

পৃথক বিবৃতিতে জিএম কাদেরের সিদ্ধান্তে বহিষ্কৃত নেতা কাজী মামুনুর রশীদ বর্তমানে দলের অন্য অংশের মহাসচিব দাবি করে বলেন, বারবার বিভক্তির কারণে সংগঠনের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। স্বৈরাচারী মনোভাব, ব্যক্তিস্বার্থ ও একগুঁয়েমির কারণে দল বারবার বিভক্ত হচ্ছে। জাপার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

জাপার ক্ষুব্ধ নেতারা মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বড় বাধা জিএম কাদের। লক্ষণীয় বিষয়, দলে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি থাকলেও ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীর প্রতি কাউকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। ফলে গতকাল মহাসচিব পদ পাওয়ার পর থেকে নির্ভার থেকে দল গোছানোর অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন তিনি গণমাধ্যমের কাছে।

এর আগে জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিগত নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়ার অভিযোগে জাতীয় পার্টির ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামীবিরোধী প্রায় সব প্ল্যাটফর্মের নেতাকর্মীরা। এর জেরে মামলার জালে আবদ্ধ হন পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে সরকারের কোনো বৈঠকে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। এমন চাপেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে নেতাকর্মীদের। কিন্তু হঠাৎ করে কেন দলের নেতৃত্ব বদলের সিদ্ধান্ত হলো, তার ব্যাখ্যা নেই নেতাকর্মীদের কাছে।

জাতীয় সম্মেলনের দাবি : গত সোমবার দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং মহাসচিব বদলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে এই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দেন। একদিন পর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আসেন তারা। এ সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি ও স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মন্তব্য করে অব্যাহতি পাওয়া দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা এখনও স্বপদে বহাল আছি। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দলের চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।’ নেতৃত্বের নির্বাচনে জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের দাবি জানান ব্যারিস্টার মাহমুদ।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘জিএম কাদের রাতের অন্ধকারে জোর করে চেয়ারম্যান হন। এরশাদ সাহেব তখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। সে অবস্থায় জোর করে তার কাছ থেকে সই নেওয়া হয়েছিল। একটি গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে এমন অনিয়ম চলতে পারে না।’

জাতীয় পার্টি থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ?‘আমরা চেয়ারম্যানের চিঠি পেয়েছি।… চেয়ারম্যানকে বলব, আমরা আপনাকে বহিষ্কার করিনি। আবার বৃহত্তর ঐক্য করব। দল ভাঙবে, দল ছোট হবে, এই রাজনীতি আমরা করব না।’

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ছোট হতে হতে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। একদম ধ্বংসের কিনারায়। সেখান থেকে জাতীয় পার্টিকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়, সে জন্য এই সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির অব্যাহতি পাওয়া সদ্য সাবেক মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সহিদুর রহমান টেপা প্রমুখ।

পরে সাংবাদিকদের কাছে দলটির নতুন মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রেসিডিয়াম মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল জাতীয় কাউন্সিল হবে ২৮ জুন হবে। সেই মিটিংয়ে দু-একজন বলেছিলেন, যদি আমরা হল ভাড়া না পাই প্রয়োজনে কাকরাইল পার্টি অফিসে করে নেব। তবে এ সংক্রান্ত কোনো রেজ্যুলেশন পাস হয়নি। সেভাবে আমরা চীন মৈত্রী কনভেনশন হলে প্রাথমিক বুকিং দিই। যা পরে রাষ্ট্রীয় কারণে ক্যান্সেল করা হয়। পরে ২৭ তারিখ বুকিং দেওয়ার চেষ্টা করি, সেটিও আমরা পাই না। নিরাপত্তার কারণে আমাদের হলরুম দেওয়া হয় না। স্বাভাবিক। যেহেতু কাউন্সিল একটি বিশাল বিষয় সেখানে ডেলিগেটরা থাকেন, অ্যাম্বাসেডররা থাকেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরা থাকেন, সাংবাদিকরা থাকেন। পরে কাউন্সিল পিছিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে পার্টির নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। জিএম কাদেরকে বহিষ্কার করার পদক্ষেপ নেন এবং ২৮ জুন বিকল্প কাউন্সিল করার উদ্যোগ নেন।’

সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র মেনে নেতৃত্ব বদল হয়েছে : ব্যারিস্টার পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে বিকল্প কাউন্সিলের সুযোগ নেই। আমাদের গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে, প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে আলোচনা করে চেয়ারম্যানের সম্মতিতে চূড়ান্ত হবে। কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করবেন পার্টির চেয়ারম্যান। সুতরাং চেয়ারম্যান ছাড়া বিকল্প কাউন্সিলেরও সুযোগ নেই। এ অবস্থায় প্রতিক্রিয়া হলে আমরা তৃণমূল নেতাদের ডাকি; ৬৫টি ইউনিটের নেতারা ছিলেন। সবাই জিএম কাদেরের প্রতি আস্থা রাখেন। যারা জিএম কাদেরকে বহিষ্কার ও কাউন্সিলের কথা ভেবেছেন তাদের বহিষ্কারের দাবি তোলেন। এর পর আমরা প্রেসিডিয়ামের মিটিং ডাকি। সেই মিটিংয়ে ২৫ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে, যারা এই অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে দলের প্রাথমিক পদসহ সব পদ থেকে বের করে দিতে হবে। সেই প্রেসিডিয়ামের রেজ্যুলেশনের ভিত্তিতে আমাদের দলের গঠনতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী বহিষ্কার করা হয়। যেহেতু অবৈধ কার্যক্রমে তদানীন্তন মহাসচিব (মজিবুল হক চুন্নু) ছিলেন, তাই তাকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেই শূন্যপদ আমাকে দেওয়া হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। … আরেকটা কথা বলা হচ্ছে, কাউন্সিল ঘোষণার পর দলের নেতৃত্ব বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আসলে নেওয়া যাবে এটা গঠনতন্ত্রের কোথাও নেই।’

এরশাদের আমলের মতোই সিদ্ধান্ত আসছে প্রেস রিলিজে : দলের এ অবস্থা নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১ ডজন নেতা। তাদের ভাষ্য, জাতীয় পার্টির রাজনীতি এমনিতে স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু দেশের সামগ্রিক রাজনীতি কিংবা জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে দলের মধ্যে সংকট তৈরি হয়। বিষয়টি কাকতালীয় হতে পারে। অদৃশ্য সুতোর টানের ইঙ্গিতকেও আমলে নিতে চান তারা। তারা মনে করেন, পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়েও তাই হয়েছে। নির্বাচনের সময় তিনি মিনিটে মিনিটে সিদ্ধান্ত বদলাতেন। কখনো কখনো তিনি সবার অগোচরে চলে যেতেন, প্রেস রিলিজে সিদ্ধান্ত আসত। নির্বাচন হয়ে গেলে আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত। এখনও তাই হচ্ছে বলে মনে করেন এই নেতারা। জিএম কাদের কিছুদিন আগে হঠাৎ রহস্যজনক সিদ্ধান্ত দিলেন- মিডিয়াতে আর কথা বলবেন না। যাবতীয় কথা বলবেন শামীম হায়দার পাটোয়ারী। এর পর থেকে প্রেস রিলিজে সিদ্ধান্ত আসতে শুরু করেছে বলে জানান তারা। এ অবস্থার উত্তরণ নির্বাচনের আগে হবে না বলে মনে করেন তারা।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com