গণ-অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দলে আরেকটি অংশ নতুন ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আসছে। কার্যক্রম স্থগিত হওয়া ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র সাবেক নেতারা থাকছেন মূল দায়িত্বে। তাঁদের পাশাপাশি এ সংগঠনের সঙ্গে আরও যুক্ত হচ্ছেন ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগী এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাধ্য হয়ে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া কোনো না কোনোভাবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ততা ছিল, এমন শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ নতুন সংগঠনে থাকছেন। তবে শিবিরের পদধারী কোনো নেতা এই সংগঠনে যুক্ত হচ্ছেন না।
আন্দোলনের প্রথম পর্বে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনে ১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল শাখার নেতা-কর্মীদের অনেকে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ তখন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। যদিও তখন তাদের সাংগঠনিক পরিচয়ের বিষয়টি সেভাবে সামনে আসেনি।
সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন ছাত্রসংগঠনের উদ্যোক্তাদের কয়েকজন জানান, আওয়ামী লীগের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে। হলে ওঠা থেকে আসন পাওয়া—সবই নির্ভর করত ছাত্রলীগের নেতাদের ইচ্ছার ওপর। হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে মাস্টারদা সূর্য সেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান ওরফে জিমের কথা বলেছেন ওই উদ্যোক্তারা। আশিকুর ছাত্রলীগের সূর্য সেন হল শাখা কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে তিনি প্রথম ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পরে আশিকুরের মতো অনেকে আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে তখন ছাত্রলীগের পদ ছেড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি থেকে পদত্যাগ করা নেতার সংখ্যা দুই শতাধিক হবে।
আবার কোনো পদে ছিলেন না, কিন্তু বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন, এমন অনেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ থেকে দূরে সরে যান। যেমন সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থী লিমন মাহমুদ হাসান ও অমর একুশে হলের মহির আলম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন তাঁরা। তাঁদের মতো ছাত্রলীগ ছেড়ে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক। এ ধরনের শিক্ষার্থীদেরও নতুন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত করতে চাইছেন উদ্যোক্তারা।
গণ–অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে তার সঙ্গে নতুন এই ছাত্রসংগঠনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন যে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে সেই দলের সঙ্গে নতুন ছাত্রসংগঠনের যুক্ততা থাকছে না।
গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করে। তখন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা করা হয়। এখন নতুন যে ছাত্রসংগঠন আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, সেটির উদ্যোক্তারা মূলত ছাত্রশক্তির সাবেক নেতা। এ সংগঠনের দুই নেতা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সাবেক নেতা আবু বাকের মজুমদার, আবদুল কাদের, হাসিব আল ইসলাম, সানজানা আফিফা অদিতিসহ বেশ কয়েকজন গণ–অভ্যুত্থানের সময় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নতুন ছাত্রসংগঠনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা তাঁরা।
নতুন ছাত্রসংগঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সাবেক সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হচ্ছেন আবু বাকের মজুমদার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব ছিলেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব পদের জন্য আলোচনায় আছেন সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলের সম্পাদক জাহিদ আহসান এবং সাবেক সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী। তাঁরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। সদস্যসচিবের পদে শেষ পর্যন্ত কে আসছেন, এখনো সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
জাহিদ ও তাহমিদের মধ্যে যিনি সদস্যসচিব হবেন না, তিনি নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক হবেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। নতুন সংগঠনের মুখপাত্র পদের জন্য আলোচনায় আছেন আশরেফা খাতুন ও রাফিয়া রেহনুমা হৃদি। তাঁরাও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে আশরেফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। আর রাফিয়া ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সাবেক নেতা আবু বাকের মজুমদার, আবদুল কাদের, হাসিব আল ইসলাম, সানজানা আফিফা অদিতিসহ বেশ কয়েকজন গণ–অভ্যুত্থানের সময় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নতুন ছাত্রসংগঠনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা তাঁরা।
নতুন ছাত্রসংগঠনের উদ্যোক্তারা জানান, সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে আলোচনায় এসেছিলেন কাদের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব পদের জন্য আলোচনায় আছেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মহির আলম ও লিমন মাহমুদ হাসান। তাঁরা একসময় ছাত্রলীগের (কোনো পদে ছিলেন না) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এ ছাড়া নতুন ছাত্রসংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখ্য সংগঠক পদের জন্য আলোচনায় রয়েছেন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাসিব আল ইসলাম ও রিফাত রশীদ। মুখপাত্র পদের জন্য আলোচনায় আছেন রাফিয়া রেহনুমা। এই তিনজনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক। তাঁরা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তিরও নেতা ছিলেন।
উদ্যোক্তারা জানান, নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি একসঙ্গে ঘোষণা করা হবে। আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ দু–এক দিনের মধ্যে হতে পারে। এ ছাত্রসংগঠনের নীতি হবে ‘স্টুডেন্টস ফার্স্ট’ ও ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’। ছাত্র-নাগরিকের স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করবে তারা।
নতুন ছাত্রসংগঠন কারও লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো ‘মাদার পার্টির’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না। নতুন সংগঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের নেতা নির্বাচন করবে বলে জানান ছাত্র নেতারা।